ইসলামের দৃষ্টিতে জল স্থলের বিপর্যয়ঃ - EDUCATION

Breaking

Around the World

Monday, April 22, 2024

ইসলামের দৃষ্টিতে জল স্থলের বিপর্যয়ঃ

আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে তা পরিমিত ও সু-বিন্যস্তভাবে সৃষ্টি করে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। তিনি জমিনকে বিছানা এবং পর্বতরাজিকে পেরেকস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন যাতে জমিন এ দিক সেদিক সরে গিয়ে কোন দুর্ঘটনা না ঘটে (সূরা নাবাঃ ৬-৭)। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র নিজ নিজ কক্ষে ঘুরছে। আল্লাহ সেখানেও ভারসাম্য স্থাপন করেছেন যাতে তাদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি না হয়ে শৃংখলা বজায় থাকে। আকাশে সূর্য এবং ভূ-মণ্ডলে বরফের পাহাড় সৃষ্টি করে আল্লাহ ঠান্ডা ও গরমের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। বায়ুমণ্ডল ও সু-শৃংখলভাবে সৃষ্টি করেছেন যাতে কোন বিঘ্ন না ঘটে। কেবল দিন বা কেবল রাত সৃষ্টি করলে জীবন অতিষ্ঠ ও একঘেয়ে হয়ে যেত। তাই দিন ও রাত উভয় সৃষ্টি করে তাদের মধ্যেও ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। সূর্যকে যদি তার স্বাভাবিক নিম্ন সীমার কিছু নিচে স্থাপন করে ঘূর্ণনের ব্যবস্থা করতেন তা হলে তার প্রচন্ড তাপে ভূ-মণ্ডল প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেত। সব পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। এছাড়া, পর্বতের বরফ গলে তার পানি প্রবাহে সমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি হতো। অন্যদিকে সূর্যকে যদি তার স্বাভাবিক উঁচু লেভেলের আরো ওপরে স্থাপন করে ঘূর্ণনের ব্যবস্থা করা হতো তা হলে ভূ-মণ্ডল প্রচণ্ড শীতে আড়ষ্ট হয়ে যেত। তাই মহাজ্ঞানী আল্লাহতা’য়ালা সূর্যকে ওপর-নিচের এক স্বাভাবিক লেভেলে ঘূর্ণনের ব্যবস্থা করেছেন যাতে মানুষ-প্রাণী স্বাভাবিকভাবে জীবন নির্বাহ করতে পারে। আল্লাহ যথাযথ পরিমাণে বনরাজিও সৃষ্টি করেছেন মানুষের মঙ্গলার্থে। পরিবেশ পন্ডিতদের মতে কোন অঞ্চলের আয়তনের কমসে কম ২৫ শতাংশ অঞ্চল বনে আচ্ছাদিত থাকা প্রয়োজন। বনরাজি বৃষ্টি বর্ষণে সহায়ক হয়, ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাস প্রতিহত করে। অন্যথায় অর্থাৎ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃক্ষ কর্তন করলে দুর্যোগ ঘটবে। আল্লাহর অভিপ্রায় হলো তিনি যেমন আসমান-জমিনে ভারসাম্য স্থাপন করে শৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন, তার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ ও যেন পৃথিবীতে তেমনি শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘সিডর’ ঘূর্ণিঝড়, কয়েক বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় ‘সুনামি’ জলোচ্ছ্বাসে ও আমেরিকায় ‘কেটারিনা’ বন্যা কেন সংঘটিত হয়েছে সে বিষয়ে নানা জনে নানা কথা বলে থাকে। কেউ বলে তা মানুষের পাপাচার ও সীমা লংঘনের জন্য, আবার কেউ বলে তা নিছক প্রকৃতির কাজ। তাই বিষয়টি তলিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করি। আসুন কোরআন ও হাদিসের আলোকে তা আলোচনা করি।

(১) সূরা আসশুরার আয়াত ৩০-এ আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে তাতো তোমাদের কর্মফল। আমি তোমাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করে থাকি (২) সূরা রূম ৪১ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্য জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে তাদেরকে কোন কোন কর্মের শাস্তি আস্বাদন করানো হয় যাতে তারা সৎপথে ফিরে আসে (৩) আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন বিপদই আপতিত হয় না (সূরা তাগাবুনঃ ১১)।

এবার হাদিসের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। বুখারী শরীফ থেকে জানা যায়, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ছোট কি বড় যত দুর্ভোগ বা হয়রানি বান্দার ওপর আপতিত হয় সবই অবশ্য নিজ কর্ম দোষে আর অধিকাংশই আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।

ওপরের উপস্থাপনা থেকে দেখা গেল মানুষের কর্ম দোষে অর্থাৎ সীমা লংঘনের জন্য জলে-স্থলে বিপদাপদ আপতিত হয়। তবে বিপদাপদ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া সংঘটিত হয় না। হাদিসে বলা আছে পিতা-মাতা সন্তানকে যত ভালবাসে আল্লাহ তার বান্দাকে তারচেয়েও বেশি ভালবাসেন। তাই কখনো কখনো মানুষের কর্ম দোষে বিপদাপদ সংঘটিত হওয়া সঙ্গত হলেও আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে বান্দাকে ক্ষমা করে দিয়ে বিপদ সংঘটিত করেন না। তবে ক্ষমার অযোগ্য হলে বিপদ সংঘটিত করেন। এটি সার্বভৌম ক্ষমতাধর আল্লাহর এখতিয়ার। আমাদের জানা উচিত যে এ প্রকৃতির পেছনে একজন স্রষ্টা আছেন যিনি তা নিয়ন্ত্রণ করেন। আকাশ মন্ডলে ও ভূ-মণ্ডলে যা আছে সবই তার আজ্ঞাবহ। যখনই তিনি কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন কেবল বলেন, ‘হও’ তখন সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে যায় (সূরা ইয়াসিনঃ ৮২)। আল্লাহ সূরা বাকারা আয়াত ১৬৪তে বলেছেন, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টিতে, তার নির্দেশে বায়ুর দিক পরিবর্তনে এবং তার কতৃêক নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবান জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে অর্থাৎ শিক্ষা রয়েছে। তাই সিডর-সুনামি-কেটারিনা- আল্লাহর নির্দেশেই সংঘটিত হয়েছে তবে তা বান্দার সীমা লংঘনজনিত কর্মের জন্য সংঘটিত হয়েছে। উল্লেখ্য, আল্লাহ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। সূরা রাদ আয়াত ১১তে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করি না যতক্ষণ না তারা নিজে নিজের অবস্থা পরিবর্তন করে।’

আল্লাহ মানুষের মঙ্গলের জন্য সৃষ্টির মধ্যে যে ভারসাম্য স্থাপন করেছেন মানুষ তা দিনে দিনে লংঘন করে চলেছে। আমার যেমন নিজের ওপর, পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে বিশ্ব তথা বিশ্ব মানবতার প্রতিও দায়িত্ব রয়েছে। এদিক দিয়ে শিক্ষিত তথা সভ্য বলে পরিচিত দেশগুলোর দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু তারা হীনমন্যতার বশবর্তী হয়ে অন্যের ক্ষতি হলেও নিজ সংকীর্ণ স্বার্থে সৃষ্টির ভারসাম্য বিঘ্নিত করে চলেছে। পাশ্চাত্য দেশগুলো এবং প্রাচ্যের কোন কোন দেশ পরিবেশের ভারসাম্য উপেক্ষা করে তাদের শিল্পের সব বর্জ সাগরে নিক্ষেপ করে সাগরের পানির বিশুদ্ধতা বিঘ্নিত করছে। ফলে, সাগর থেকে উথিত দূষিত বাষ্প বায়ুমন্ডলকে দূষিত করছে। যথেচ্ছ বৃক্ষ কর্তনের ফলে বন-বনানীর স্বাভাবিক মাত্রা বিঘ্নিত হয়ে জলোচ্ছ্বাস ও বন্যাকে রোধ করার ক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য উপেক্ষা করে অবিশ্বাস্য গতিতে যথেচ্ছ শিল্পায়ন চলছে ধনাঢ্য দেশসমূহে। ব্যাপক শিল্পায়নের কারণে অত্যধিক পরিমাণে সিএফসি ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন নির্গমন বন্ধ হচ্ছে না। এর ভয়াবহ পরিমাণে নির্গমন ওজন স্তরের অনিবার্য ক্ষয় ও অধিক মাত্রায় অতি বেগুনি রশ্মি বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে তুলছে। ফলে জলবায়ু উল্টা-পাল্টা আচরণ করছে। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালি শহরে জলবায়ুর ওপর ১৯০ জাতির এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ২০০৮ সালে পোলান্ডে এবং ২০০৯ সালে ডেনমার্কে আরো পর্যালোচনার সম্মেলন হবে। জলবায়ুর পরিবর্তন বাড়লে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যা বেড়ে যাবে। মানুষ সংশোধিত না হল আগামী ১০০ বছরে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ৪৪০ সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চলতি শতাব্দি শেষে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৯৭০ পিপিএম পর্যন্ত। উষ্ণতার কারণে হিমালায়সহ অন্যান্য পর্বতে জমে থাকা বরফের পাঁচ চতুর্থাংশই গলে যাবে। ফলে, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে ভয়াবহ বন্যা, ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হবে। ২০২০ সাল নাগাদ কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ২৫ থেকে ৪০ ভাগে নামিয়ে আনা সম্ভব না হলে মানুষের দুর্ভোগ ক্রমশ বাড়বে। প্রকৃতি আরো নির্মম হবে।

এসব মানুষই করে যাচ্ছে। কেন করে যাচ্ছে? সেরেফ নিজ স্বার্থে অন্যের ক্ষতি হলেও। মানুষ তার দায়িত্ব সম্বন্ধে ভুলে যাচ্ছে। ধনী-গরীব সব দেশকে মনে রাখতে হবে যে এ জগতের একজন স্রষ্টা আছেন। তিনি একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এটি পরীক্ষার স্থান। এখানে সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হবে। একে অপরকে সাহায্য করতে হবে। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের সবাইকে আমাদের কর্মের জন্য মৃত্যুর পর পরকালে তার নিকট জওয়াবদিহি করতে হবে। পরকাল হলো ইহকালের কর্মের ফল লাভ করার স্থান। তাই ব্যক্তি স্বার্থকে সামষ্টিক স্বার্থের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

সামষ্টিক স্বার্থের মঙ্গলার্থে ব্যক্তি স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হবে। তাই সবার স্বার্থ যতদূর সম্ভব বিবেচনায় আনতে হবে। জলবায়ুর ওপর যে আলোচনা হচ্ছে ও ভবিষ্যতে হবে তাতে অংশগ্রহণকারী সব দেশকে এ ব্যাপারে সজ্ঞান- সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে।                                        .                                    

No comments:

Post a Comment