শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন
প্রকাশক
: খুলনা সাহিত্য মজলিশ
প্রথম প্রকাশ : পৌষ ১৩৯৩’,
ডিসেম্বর ১৯৮৬ ইং
মুদ্রণ সংখ্যা : এক হাজার
মুদ্রণে: এ, এফ, এম,
শামসুর রহমান
দি ইষ্টার্ণ প্রেস, খুলনা।
প্রচ্ছদ : নিরঞ্জন রায়
ব্লক : সিটি ব্লক, খুলনা
মূল্য :
সাদা : সাতাশ টাকা মাত্ৰ
লেখক : বাইশ টাকা মাত্র
পরিবেশক : মডার্ণ বুক ডিপো
কে, ডি, ঘোষ রোড,
খুলনা।
ষ্টুডেন্ট ওয়েজ
৯, বাংলাবাজার, ঢাকা–১,
ফোন : ২৫১০৩৭
KHULNA SHAHORER AADI PARBA BY ABUL KALAM SHAMSUDDIN Published by Shahetya Majlish, Khulna. Printed at the Eastern Press, Sir Iqbal Road, Khulna. First Edition, December, 1986. Price; Taka Twenty Seven (White), Taka Twenty Two Only (Leakhak).
মা–কে
[ আমার মা!
যার প্রভাব ছিল আমার
পরে একটু বেশী। তিনি
চেয়েছিলেন শহরের কথা লেখা
হোক।
কেননা তার দেখা শহরের
কিছু অতীত কথা লোকে
জামুক। কিন্তু আমার মা’কে নতুন শহরে
জায়গা দিতে যে নিঃস্ব
আদিবাসী মা দুধের সস্তানকে
বুকে নিয়ে আশ্রয়টুকু ছেড়ে
দিলেন তার কথা কে
বলবে? ]
আমরা খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে বসবাসরত নাগরিক মূলতঃ খুলনা শহরের বুকে আজকের এই যে নিয়ন বাতির ঝলকানি—এটা কোন যাদু মন্ত্রের বিষয় নয় অনেক শতাব্দীর পথ ধরে, পরিবর্তন বিবর্তনের ধারা বেয়ে তবেই খুলনা শহরের আকাশমুখী যাত্রার শুরু হয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, যে মাটি আমাদের লালন করেছে—বড় করে তুলেছে তার উত্থান পতন সম্পর্কে বলতে গেলে আমরা অনেকেই কিছু জানিনা। কৌতূহল যে নেই তা নয় কিন্তু সাহসী কোন হাতের পথ চেয়েছিলাম। অবশেষে আমাদের সেই কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটাতে এগিয়ে এলেন জনাব আবুল কালাম সামসুদ্দিন শহর খুলনার আদি পৰ্ব নিয়ে।
সুতরাং, বলার অপেক্ষা রাখেনা, নিজের শহর খুলনার আদি গর্ব সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল হবো এবং আমাদের মতো অনেকেই আজকের খুলনাকে অতীত ইতিহাসের পটভূমিতে নূতন করে দেখার সুযোগ পাবেন, একথা ভেবেই খুলনা সাহিত্য মজলিশ সোল্লাসে বইটির প্রকাশনা পরিকল্পনার কিছু দায় দায়িত্ব
নিয়ে “শহর খুলনার আদি পর্ব” প্রকাশের পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। আমরা সকলেই এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।
আমীর আলী জোয়ার্দার
(অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ)
সভাপতি
খুলনা সাহিত্য মজলিশ
খুলনা।
আমার কথাই শেষ কথা নয়। কথা ছিল, এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখনও আছে, ভবিষ্যতেও কথা থাকবে। শহর খুলনার আদি পর্ব খুঁজতে গিয়ে যেসব তত্ত্ব ও তথ্য পেয়েছি তা আশাব্যঞ্জক না হলেও হতাশায় একেবারে দেউলে হইনি বরং একটি সত্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে আমাকে ছুটতে হয়েছে। যেখানে যা পেয়েছি খুব যত্নভরে তুলে আনার চেষ্টা করেছি—তবুও অনেক কথা হয়তো এখনও আগামী দিনের কোন স্বতৃষ্ণ গবেষকের পথ চেয়ে পড়ে আছে।
তবে একথা সত্যি বাংলা নতুন নতুন দ্বীপ সৃষ্টি বা ভূমি গঠন করেছে গাঙ্গেয় পলির ছোঁয়া নিয়ে এবং তা ক্রমে এগিয়ে গেছে দক্ষিণ থেকে দক্ষিণে। মানুষও অবস্থানের পরিবর্তন এনেছে নতুন ভূমি আকর্ষণে। এক্ষেত্রে ভূমির গঠনের সাথে মানুষের বসবাস অবিচ্ছেদ্য। প্রাচীনকাল থেকে নদ-নদীর দু’কুল ধরে গড়ে উঠেছে বহু সমৃদ্ধ জনবসতি ও নগর জনপদ । প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক কারণে কখনও কখনও এসব এলাকা পরিত্যক্ত বা বিলুপ্ত হয়েছে। পরিবর্তে এই ধ্বংসস্তুপের উপর আবার গড়ে উঠেছে নতুন জনপদ। পৃথিবীর চলমান আবর্তে এ সব খেলা নতুন কোন ঘটনা নয়। এর প্রেক্ষিতে একদিকে পুরাতন বসতির ঐতিহ্য তাদের আচার- আচরণ-সাংস্কতিক পটভূমি মাটিগর্ভে বিলীন হয়ে যায়, অন্যদিকে সেখানেই মাথা উচু করে দাঁড়ায় আর এক সভ্যতা।
এ ভাবেই সুন্দরবনের গা-ঘেঁষে মানুষের বসতির গতিধারার পরিবর্তন বয়ে গেছে যুগের পর যুগ। এই বিবর্তিত ধারায় প্রায় দেড়শ’ বছর আগে খুলনা শহরে নতুন নগর জনপদের সূচনা হয়েছিল। ইংরেজ সরকার ভৈরব তীরের প্রাচীন বসতির যে অংশে মহকুমা সদরের পত্তন করেছিলেন তারও উত্থানপতন ও বিবর্তনের একটা ইতিবৃত্ত ছিল এবং স্বাভাবিকভাবে এ বসতি শহর পর্বে বিলীন হয়ে যায়। সে কথা আজ ঘুমিয়ে পড়েছে বিস্মৃতির কোলে।
বড় শহর বা ঐতিহাসিক নগরের একাধিক ইতিবৃত্ত লিখিত আছে, কিন্তু বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছোট জেলা শহর খুলনার আটষট্টি বছরে শহরের অধিবাসীরা কে কোথা থেকে এসেছেন ও কিভাবে শহর গড়ে উঠেছে তার সবকথা সবারই জানা, এর ইতিবৃত্ত কোথায়! আর পূর্ব বসতির নিম্ন পেশার দারিদ্র পীড়িত দু’চার জন যারা ছিলেন তারা নবাগতদের আর্থসামাজিক প্রতিপত্তির প্রতিযোগিতায় ও শহর গঠন ক্রিয়ায় নেহায়েত অবজ্ঞাত। যার ফলে কোন ইতিবৃত্তের কথা কেউ ভাবেননি। ’৪৭ সালে খুলনা পাকিস্তান ভুক্ত হলে এতোদিনের শহরের বসতির নতুন করে পরিবর্তন শুরু হয়।
পঞ্চাশের দশকে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছে খুলনার গুরুত্ব গভীরভাবে অনুভূত হয় এবং নতুনভাবে বিন্ন্যাস করে বন্দর ও শিল্প নগরীতে রূপায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ সাপেক্ষে শহরের দ্রুত রূপান্তর হতে থাকে। এক পর্যায়ে নবাগত বসতির কাছে শহর গঠন পর্বের অনেক উপ-কথার সৃষ্টি হয় যার সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক ছিলনা। এর ফলে ষাটের দশকে একটা বাস্তনানুগ তথ্যভিত্তিক ইতিবৃত্ত অনুভূত হয় কিন্তু তা আলো-পানির অভাবে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে।
প্রায় এক দশক আগে আমার অনেক শুভানুধ্যায়ীর প্রেরণায় কাজ শুরু করি এবং সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র, শহরের প্রবীণদের সাক্ষাৎ সহ তাদের সাথে আলোচনা করে তথ্যভিত্তিক ইতিবৃত্ত তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। এদের অনেকেই আজ লোকান্তরিত। বাহুল্য হলেও সত্য যে, সেই চেষ্টার ফসলই “শহর খুলনার আদি পৰ্ব”, অবশেষে পাঠক ও অনুসন্ধিৎসু রাজনদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি—এটা যে সম্ভব হবে তা আদৌ কোন দিন ভাবিনি আর ভাবিনি বলেই সমস্ত ভুল-ত্রুটি সংক্রান্ত অপবাদ আসতে পারে জেনেও কিছুটা আনন্দ বোধ করছি।
আবুল কালাম সামসুদ্দিন
৮ নং মির্জাপুর রোড,
খুলনা।
২৫–১২—৮৬
প্রকাশনায় : শেখ মোহাম্মদ ইসমাইল, ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবী, মির্জাপুর রোড। রশীদ আহম্মেদ, প্রাক্তন ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও এন এ পি নেতা। মোহম্মদ আব্দুল গনি, ব্যবস্থাপক, মেরী টাইম এভেন্সী, খুলনা।
তথ্য সংগ্রহে : সৈয়দুর রহমান, কবি ও শিশুতোষ গল্প লেখক, মির্জাপুর রোড। মতিয়ার রহমান; কবি ও যুব নেতা—মতিয়াখালি। শাদত রিপন, ছড়াকার ও ছোট গল্প লেখক—মতিয়া খালি। মোহাম্মদ হানিফ, তরুণ অনুসন্ধিৎসু—মির্জাপুর রোড, খুলনা।
বিভিন্ন ভাবে : আবদুল হালিম, (এ্যাডভোকেট লেখক, পুরাঘটিত বর্তমান। মীর আমীর আলি, লেখক—খুলনা শহরের ইতিকথা। আলি হোসেন মনির, নাটক ও ছোট গল্প লেখক–বাগমারা প্রধান সড়ক।
প্রেসকপি লিখেছে : সাবিনা মমতাজ ডলি, ছাত্রী, তড়িৎ কৌশল। মির্জাপুর রোড, খুলনা।
সৰ্ব্ব জনাব, দেলদার আহম্মেদ, প্রবীণ আইনজীবী ও প্রাক্তন মন্ত্রী। আবু মহম্মদ ফেরদাউস, সভাপতি, খুলনা জেলা ন্যাপ। আবদুল ওয়াহেদ, প্রবীণ আইনজীবী ও খুলনা গার্লস কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক। এ, বি, এম, রোকন উদ্দিন, প্রবীণ আইনজীবী। আঃ লতীফ, প্রবীণ আইনজীবী—টুটপাড়া। নজির আহম্মদ, প্রাক্তন সভাপতি, মোক্তার বার সমিতি। দীন মহম্মদ, রাজনীতিবিদ – বেনেখামার। আবু মহম্মদ ইউনুছ, প্রাক্তন পোষ্ট মাষ্টার। শরত্চন্দ্র সাহা, প্রবীণ আইনজীবী। আবুল হোসেন, সম্পাদক, নাট্য নিকেতন। শামছুল হুদা, প্রাক্তন সম্পাদক, জেলা ক্রীড়া সংস্থা। আফিল উদ্দিন, প্রাক্তন সম্পাদক, জেলা মুসলিম লীগ। ডাঃ দেবেন্দ্ৰ নাথ পাল, চিকিৎসক ও প্রাক্তন কংগ্রেস কর্মী। কালিপদ দাস (কালাদা) গরামানিক পাড়া (তালতলা)। আবু আহমেদ, প্রাক্তন পৌর কমিশনার, গোবরচাকা। মুহম্মদ আজিজ হাসান, সম্পাদক, উমেশ চন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরী। রবীন্দ্র নাথ মজুমদার, সম্পাদক, আর্য্য ধর্মসভা। শঙ্কর রায় চৌধুরী, সম্পাদক, কয়লাঘাট কালী – বাড়ী, আবদুস ছাত্তার (ক্যাপ্টেন সাহেব) প্রাক্তন খেলোয়াড়, মুসলিম ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, কলিকাতা। শ্যামাপদ চ্যাটার্জী, প্রাক্তন খেলোয়াড়, টাউন ক্লাব। অমুল্য কুমার ব্যানার্জী, বেনেখামার (ক্ষিরোদ ব্যানার্জীর ভাই)। নওসের আলি খান, (দৌহিত্র, বাবু খান)—টুটপাড়া। অনিল ঘোষ, ঠিকাদার, কালীবাড়ী রোড। কিরণ চন্দ্র সরকার, প্রাক্তন জুরি, টুটপাড়া। শিবপদ হুই, ব্যবসায়ী – মির্জাপুর রোড। সাধন সরকার, প্রবীণ গায়ক ও সুরকার—মির্জাপুর রোড। সামছুদ্দিন, প্রবীণ গায়কও সংগীত শিক্ষক—টুটপাড়া। অজিত কুমার দেবনাথ, সম্পাদক কেশব চন্দ্ৰ সংস্কৃত বিদ্যা মন্দির। কালীদাস ব্যানার্জী, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রূপসা শ্মশান ঘাট কালীবাড়ী। মনিলাল দাস, প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মচারী, খুলনা ইলেকটিক সাপ্লাই কোঃ লিঃ- তালতলা রোড। যোগেশ চন্দ্র দাস, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক। শেখ শহিদুল ইসলাম, শিক্ষক—সোনাডাঙ্গা। শ্রীমতী বীণা রায়, হীরালাল রায়ের কন্ঠা—রায়পাড়া রোড। শ্রীমতী মলিনা দাস, স্ত্রী, প্রমথ নাথ দাস। মৌলবী হাসান আলি, প্রাক্তন মৌলবী ও রেজিষ্ট্রার টুটপাড়া কবরখানা। শেখ কোরবান আলি, গৃহস্থ—বেনে খামার। শেখ মহম্মদ আলি, ব্যবসায়ী – বেনে- থামার। শেখ শের আলি, চাকুরীজীবী—বেনেখামার। শেখ লুৎফার রহমান, বেনে, খামার। আজিজুর রহমান (ফেলু ফকির) – বেনেখামার। চন্দ্র কান্ত রায়, বাগমারা। আশুতোষ রায়, বানরগাতী। ছাকায়াত হোসেন, প্রাক্তন শিক্ষক, সেন্ট যোসেফস স্কুল। গোপীনাথ দত্ত, প্রাক্তন কর্মচারী, চেম্বার অব কমার্স, নগেন্দ্ৰ নাথ পাল, দেয়াড়া, খুলনা।
সূচনা
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন সূচনা
ভাটিবাংলার ভৈরব কপোতাক্ষতীরে মানুষের বসতি যেমন প্রাচীন তেমনি বিচিত্র। এক এক সময় মানুষ গড়ে তুলেছে সুন্দর সুন্দর গ্রাম জনপদ, তুলেছে ফসলে ফসলে মাঠ। দু’কূল ধরে সৃষ্টি হয়েছে কত রাজপাট আর বাণিজ্য বন্দর। এভাবে চলেছে কিছুদিন। তারপর আকস্মিক কোন প্রাকৃতিক বা রাজনৈতিক বিপ্লবে ধ্বংস হয়েছে মানুষের স্বপ্ন সাধ আর রাজপাট। সরে গেছে মানুষ নিরাপদ জায়গায়। আবার একদল মানুষ এসেছে, গড়ে তুলেছে নতুন জনপদ। এভাবে ভাঙ্গা গড়ার মধ্যদিয়ে এগিয়ে গেছে এ-দু নদীর তীরবর্তী মানুষের ইতিবৃত্ত, সৃষ্টি হয়েছে আগ্রা-কপিলমুনি, বার বাজার, ব্রাহ্মণ্য নগর, খলিফাতাবাদ।
সুপ্রাচীন কাল থেকে ভৈরব-তীরের জনপদগুলোর একটা ঐতিহাসিক গতিধারা ছিল যা যুগ বিবর্তনে তলিয়ে গেছে পরবর্তী যুগে। এর মধ্যে যেটুকু কিংবদন্তী লোকগাঁথা—পুরাকীতি-মূদ্রা-শিলালিপি ইত্যাদির মধ্যে উদ্ধার করা গেছে তাও বিতর্ক মুক্ত নয়। বোধগম্য কারণে এসব ইতিবৃত্তে যৌক্তিকতা হারিয়ে অনেক ক্ষেত্রে হয়ে গেছে একপেশে। ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে প্রশাসনের সুবিধার্থে প্রত্যেক প্রশাসনিক এলাকায় একটা পুরাকালীন ইতিবৃত্তে পরিচয় (গেজেটিয়ার) তৈরী করলেও সার্বিক ইতিহাস বিবেচনায় ক্রটিমুক্ত নয়। এমতাবস্থায় আঞ্চলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিবৃত্তে অনুসন্ধিৎসু পাঠক নানা মতের ভারাক্রান্তে বিব্রত।
পরিচয়
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন পরিচয়
এমনি গড়ে ওঠা এক নগর জনপদ খুলনার ইতিবৃত্ত খুব প্রাচীন প্রাচীন নয়। ইংরেজ প্রশাসনের প্রথম মহকুমা ও মহকুমা সদর শহরের ভিত্তি স্থাপিত হয় ভৈরব ও রূপসা খালের মিলিত স্থানের কোণে। ওই একই স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় কনিষ্ঠতম জেলা ও জেলা সদর শহরের। ১৯৮২ সালে পালিত হয় জেলার জন্মশত বার্ষিকী। সেদিনের প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম মহকুমা শহর আজকের বিভাগীয় সদর শিল্প ও বন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। এবং দেশের দ্বিতীয় বন্দর, শিল্প নগর ও পাট রপ্তানী কেন্দ্ৰ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত।
১৯৪৭ সালের ইংরেজ শাসনের শেষদিন পর্যন্ত খুলনা শহর ছিল প্রেসিডেন্সী বিভাগের অধীন ছোট জেলা শহর। খুলনা শহরের সাথে সড়ক ও রেল যোগাযোগ যুক্তবাংলার পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীবন্দর ও বৃহত্তম ব্যবসা কেন্দ্র কলিকাতার সাথে সম্পর্কিত পশ্চাৎভূমি হিসাবে কলিকাতা বন্দরের আমদানী রপ্তানীকৃত মালামাল রেল পথে এসে নদীপথে পূর্ববঙ্গের বরিশাল-ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় যাতায়াতেরও মাধ্যম ছিল এ শহর। ৪৭ সালের পরে কলিকাতা বন্দরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় নতুন বন্দরের। তৎকালীন সরকার পঞ্চাশের দশকের গোড়ারদিকে শহরের অদূরে চালনা বন্দর নির্মাণ করে এ ঘাটতি পূরণ করেন। নিকটবর্তী বন্দর সুবিধায় শহরের পার্শ্ববর্তী খালিশপুর গ্রামে ভৈরব তীর ধরে দ্রুত গড়ে উঠতে থাকে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা। বন্দর ও শিল্প কারখানা কেন্দ্র করে শহরে নতুনভাবে জনবসতির চাপ সৃষ্টি হতে থাকে এবং ষাটের দশকের গোড়ার দিকে (অক্টোঃ ১১৬১) জেলাকে বিভাগে উত্তীর্ণ করে পুর্বের পৌরসভা এলাকার সংলগ্ন বয়রায় দ্রুত নির্মিত হয় বিভাগীয় সদর দফতর। এ সবের প্রয়োজনে দেখা দেয় শহর ও পৌর এলাকার সম্প্রসারণ। পুর্বতন পৌরসভা এলাকা উত্তরে জোড়াগেট থেকে দৌলতপুর-খালিশপুর এলাকাভূক্ত করে রেলগেট পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে বর্ধিত পৌর এলাকা হয় ১৪.৩০ বর্গমাইল এবং খালিশপুর শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিপরীত দিকে যশোর (পুরাতন) রাস্তার উত্তর পাশে নির্মিত হয় নতুন উপ শহর। এ লক্ষ্যে নতুনভাবে নিৰ্মিত হয় আধুনিক আইল্যাণ্ড, ফুটপাথ আর নিয়নবাতিতে সজ্জিত সড়ক-মহাসড়ক, রাজপথ ও জনপথ। এভাবে শুরু হয় বর্তমান খুলনা শহরের নববেশে নগরীর দিকে অগ্রযাত্রা। চল্লিশ বছরের মহকুমা সদর ও সত্তুর বছর ধরে গড়ে ওঠা জেলাশহর। আজকে শহরের আঙ্গিকে হারিয়ে গেছে তার কত কথা–কত স্মৃতি। বিলুপ্ত হয়ে গেছে তারও আগের গড়ে ওঠা জনপদগুলোর রেখা। রয়ে গেছে মুখ পরষ্পরায় দু’একটি নামের স্বাক্ষর, যা আজও বিব্ৰত করে ইতিহাসের স্মৃতি সূত্রে। শত বছর শেষের আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু শহরবাসী তার অতীত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জীর কথা জানতে আগ্রহী, কিভাবে গ্রন্থিত হয়েছিল সামগ্রীক নাগরিক জীবন ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের অন্য অংশের মত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অন্তর্গত ভৈরব নদীতীরের এ অংশ তত প্রাচীন নয়। গঙ্গা নদী পলি প্রবাহে সমুদ্রস্থিত দ্বীপমালা ক্রমে একত্রিত হয়ে কয়েকটি বড় দ্বীপ ও বহু নদীর সৃষ্টি হয়েছিল। গঙ্গার শাখা হলদিনীর মোহনায় সৃষ্ট বুড়নদ্বীপ বর্তমান খুলনার অধিকাংশ নিয়ে গঠিত ছিল এবং এ অংশে প্রাচীন নাম বুড়নদ্বীপ। মেঘাস্থিনিস বর্ণিত গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি নামে একটা শক্তিশালী বিস্ততে রাজ্য ছিল। আলেকজাণ্ড’র ভারত আক্রমণ কালে (৩২৭খৃঃ পূঃ অঃ) এই রাজ্যের হস্তিসেনা শক্তির কথা শুনে অগ্রসর হতে সাহসী হননি। ঐতিহাসিকগণ বুড়নদ্বীপ এ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করেন। গুপ্ত যুগে বুড়নদ্বীপ গুপ্তসাম্রাজ্যভুক্ত হলে এর প্রশাসনিক নাম হয় খাড়িস্থান। বৌদ্ধযুগে সমগ্র ব-দ্বীপের নাম হয় বকদী বা বাগদী। পাল ও সেন রাজগণের সময় বুড়নদ্বীপ তাদের রাজ্যভুক্ত ছিল। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি লক্ষণাবতি আক্রমণ করলে রাজা লক্ষণসেন ভৈরব পথে বিক্রমপুর পালিয়ে যান এবং বুড়ন দ্বীপে লক্ষণ সেনের উপ শাসন (শঙ্খনূর বা শাঁখহাটী) কেন্দ্ৰ ছিল বলে জানা যায়। সেন রাজত্বকালে ভৈরবতীরে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থগণ ভূমি প্রাপ্ত হয়ে বসতি স্থাপন করেন এবং এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পুৰ্ণ গ্রামগুলি তৎসময়ে গড়ে ওঠে।
বঙ্গে মুসলিম বিজয়ের পর শতাধিক বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে জানা যায়না। সম্ভবতঃ গৌড় সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩১০-১৩২৫ খ্রীঃ, প্রথম খুলনা দখল করেন এবং শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময়ে (১৩৪২-১৩৫৮ খ্রীঃ) খুলনায় মুসলিম বসতি শুরু ও বিস্তার লাভ করে। অবশ্য বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় প্রাচীন বুড়নদ্বীপে আরো আগে মুসলিম আগমন ও বসতি হয়েছিল। সম্ভবতঃ ভৈরব তীরের এ অংশেও আলোচিত সময়ে মুসলিম বসতি গড়ে উঠেছিল। পাঠানযুগে এ অঞ্চল সরকার খলিফাতাবাদের অধীন ছিল এবং মোগল শাসন আমলে যশোরের ফৌজদার কর্তৃক শাসিত হতো।
১৭৮১ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী যশোরে মুড়লীতে একটা শাসন কেন্দ্র স্থাপন করে মিঃ টিলম্যান হেঙ্কেলকে ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত করেন এবং কোম্পানীর লবণ ব্যবসায়ের সুন্দরবন অঞ্চলের প্রধান কেন্দ্র রায় মঙ্গল লবণ এজেন্সীর সদর দফতর স্থানান্তর হয় খুলনায় (শহরের কমলাঘাটায়)। খুলনা তখন রূপসা নদীর (সরু খাল মাত্র) অপর পারে নিকলাপুর গ্রামের উত্তর পূর্ব দিকে ভৈরব নদীর তীরে একটা ছোটগ্রাম। প্রাচীনকালে খুলনা বিস্তৃত গ্রাম ছিল।। সুন্দরবনের কাঠ গোলপাতা মধু সংগ্রহকারী মাঝি ও ব্যবসা বাণিজ্যের বড় বড় নৌকা ও জাহাজ যাতায়াতের পথে ভৈরব নদীর আত্রাই থেকে রূপসা পর্যন্ত ভয়াবহতার জন্য এখানে অবস্থান করতো। ভৈরব রূপসার মিলিতস্থান থেকে উত্তর পশ্চিমে আত্রাই নদী, যেখানে ভৈরবের সাথে মিলিত হয়েছে। পূর্বে আত্রাই আরও পশ্চিমে ভৈরবের সাথে মিলিত ছিল। এখান থেকে ভৈরব রূপসার মুখ পর্যন্ত সোজা একটা বাঁক ও রূপসার মুখ থেকে আলাইপুর পর্যন্ত অপর একটা গোলা বাঁক ছিল। ভৈরব ও আত্রাই নদীর প্রচণ্ড স্রোত মিলিত স্থানে প্রবল ঘূর্ণিস্রোতের সৃষ্টি করতো এবং এই ত্রিমোহনী থেকে রূপসা খালের মুখ পর্যন্ত কয়েকটা ঘূর্ণিস্রোত বছরের প্রায় সব সময় থাকতো। বিশেষ করে বর্ষাকালে এই বাঁকে নৌকা চালান খুবই ভয়াবহ ছিল। মাঝিরা এই বাঁকে সতর্কতার সাথে যাতায়াত করতো এবং রাতে মাঝিরা দুই বাঁকের মিলিত স্থানের কিছু পূর্বে নৌকায় ও জাহাজ বেঁধে অবস্থান করতো ও দিনে অবস্থা বুঝে নৌকা খুলতো। মাঝিদের এই অবস্থানের নদীর বিপরীত দিকে সেনের বাজার বেশ বড় মোকাম ছিল। অবস্থানরত মাঝিদের প্রয়োজনীয় হাট-বাজারের কাজ এখানে সেরে নিত। সেনের বাজার কালক্রমে খুব বড় ব্যবসাকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উল্লেখ্য বর্তমান সেনের বাজার যেখানে অবস্থিত সেখান থেকে প্রায় দেড় মাইল পূর্বে অবস্থিত ছিল। নদীর ভাঙ্গনে ক্রমাগত সরতে সরতে বর্তমান জায়গায় এসে পৌঁছেছে। সেনের বাজার বর্তমান খুলনার (শহর) ঠিক উত্তর পাশে অবস্থান নিয়ে তার প্রাচীন মিতালি অক্ষুণ্ণ রেখেছে।
নদীর বাঁকে অবস্থানরত কোন অজ্ঞাত মাঝি জোয়ার ভাটার (মাঝিদের ভাষায় গোণ) কারণে সন্ধ্যায় বা রাতে নৌকা খুলতে উদ্যত হলে, তখন নদীর ভয়াবহতা সম্পর্কে জ্ঞাত মাঝিরা গমনোদ্যত মাঝিদের খুলনা-খুলনা বলে নৌকা খুলতে নিষেধ করতে। অনেক সময় নদীতীরের অধিবাসীরাও গমনোদ্যত মাঝিদের অনুরূপভাবে সতর্ক করে দিত। এইভাবে আত্রাই থেকে আলাইপুর পর্যন্ত ভৈরব নদীর দুই বাঁকের মধ্যবর্তী রূপসা খালের পুবে নদীর দক্ষিণ তীরের এ জায়গা খুলনার বাঁক নামে পরিচিত হয়। মাঝিরা নদীপথের দূরত্ব সাধারণতঃ বাঁক দিয়ে নির্ণয় ও বাঁধের পরিচিতি দিয়েই বাঁকের নামকরণ করতো। এ পরিচয়ে নিকটবর্তী জায়গা ও বসতি পরিচিত হয়ে খুলনা নামে গ্রামের নাম হয়। এভাবে গ্রামের নানকরণ উপবঙ্গে যথেষ্ট উপমা পাওয়া যায়।
বঙ্গে মুসলিম বিজয়ের পরবর্তীকালে ভৈরবতীর দিয়ে ক্রমাগত মুসলিম বসতি বিস্তারলাভ করতে থাকে। তখন খুলনা নামের বিস্তৃত এলাকার এক এক অংশ বিভিন্ন সময়ে তালিমপুর (তালিবপুর), নিকলাপুর, ইলাইপুর (এলাহীপুর) ও নয়াবাদ প্রভৃতি গ্রাম গড়ে উঠলে খুলনা নামের বিস্তৃত অঞ্চল সংকুচিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে খুলনার সাথে কিসমতযুক্ত হয়ে ছোটগ্রাম প্রাচীন নামের ধারায় কিসমত খুলনা মৌজা গঠন করে খুলনা নামের ঐতিহ্য কোনরকমে রক্ষা পায়। উল্লেখ্য সুলতানী আমলে রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার্থে পরগনা, মহল, কিসমতে বিভক্ত হয়। প্রত্যেক কিসমত এলাকার কেন্দ্র যেখানে অবস্থিত ছিল সে গ্রামের নামের সাথে কিসমত যুক্ত হয়ে কিসমত খুলনা, কিসমত ফুলতলা, কিসমত ডুমুরিয়া ইত্যাদি নামে পরিচিত হয়।
নামের উৎপত্তি ও প্রবাদ
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন নামের উৎপত্তি ও প্রবাদ
খুলনা নামের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। “পূর্বকালে সুন্দরবনের নিকটবর্তী ছিল। লোকে সুন্দরবন থেকে কাঠ, গোলপাতা, মধু সংগ্রহে এ পথে সুন্দরবন যেত এবং বোঝাই নৌকা নদীর ভয়াবহতার জন্যে রাতে এখানে অবস্থান করতো। কোন অজানা মাঝি রাতে নৌকা খুলতে গেলে জঙ্গল মধ্য থেকে বন দেবতা খুলোনা খুলোনা বলে মাঝিদের নিষেধ করতো। এই খুলোনা থেকে খুলনা নামের উৎপত্তি হয়েছে।”
অপর প্রবাদ “কবি কঙ্কন বিরচিত চণ্ডিকাব্যের ধনপতি উপাখ্যান বর্ণিতা ধনপতি সওদাগরের লহনা-খুলনা নামে দুই স্ত্রী ছিল। কনিষ্ঠা আদরিণী খুলনার স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে একটা মন্দির নির্মাণ করে মন্দিরের নাম রাখেন খুল্লেনেশ্বরী মন্দির। প্রথমা স্ত্রী লহনার নামে নদীর অপর পারে লহনেশ্বরী মন্দির নির্মাণ করেন। এ মন্দির উলুবনের কালীবাড়ী নামে পরিচিত। খুল্লেনেশ্বরী মন্দির থেকে খুলনা নাম হয়েছে।”
প্রথমোক্ত প্রবাদের অনুকরণে সৃষ্ট তৃতীয় প্রবাদ “সুন্দরবন থেকে কাঠ, গোলপাতা, মধু বোঝাই নৌকাগুলি ময়ুর নদীতে অবস্থান করতো। রাতে চলাচলকারী মাঝিদের ঝড় বা কোন বিপদাশঙ্কা থাকলে জলদেবতা খুলোনা খুলোনা বলে নিষেধ করতেন। এর থেকে খুলনা নামের সৃষ্টি হয়েছে।” উল্লেখ্য ময়ুর নদী কোনদিন খুব দীর্ঘ ও প্রশস্ত ছিলনা এবং খুলনা নামে পরিচিত গ্রাম থেকে অনেক দূরে।
সাম্প্রতিক আরো একটি প্রচলিত প্রবাদ–“প্রাচীন কালে আরবীয় বণিকেরা বাণিজ্যার্থে এখানে এসে বলতো ‘আদ খালনা’। এই ‘আদ-খালনা’ থেকে খুলনা হয়েছে।”
প্রথমোক্ত প্রবাদদুটি অনেক আগে থেকে প্রচলিত এবং অন্য অন্য প্রবাদগুলি বর্তমান কালের। ঐতিহাসিকরা প্রবাদগুলির যৌক্তিকতা স্বীকার করেন না।
মহকুমা গঠনের কারণ
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন মহকুমা গঠনের কারণ
সতের শতকের গোড়ার দিকে এ ধারা অব্যাহত ছিল। অর্থাৎ এসময়েও নদীর এপথে যাতায়াতকারী সব নৌকা ও জাহাজ এখানে অপেক্ষা করত। ইংরেজ আমলের প্রথম থেকে খুলনা ইংরেজদের ব্যবসা বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান ঘাঁটি বা বন্দর ছিল। পূর্ববঙ্গ, আসাম, কলিকাতা ইংরেজ বাণিজ্য কেন্দ্রের চলাচলের সহজ পথ ছিল খুলনা হয়ে। ফলে খুলনা আগে থেকেই ছোট খাট একটি বন্দর ছিল। এ ছাড়া যশোরের দেওয়ানী লাভের সাথে সাথে তাদের লবণ বিভাগের সদর দফতর রায় মঙ্গল লবণ এজেন্সী স্থানান্তর হয় খুলনার কয়লাঘাটায়। ফলে ইংরেজদের নৌ বাণিজ্যে এ জায়গার গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। ওই বছর অর্থাৎ ১৭৮১ সালে বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কাজের জন্যে খুলনায় প্রথম থানা স্থাপিত হয়। প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি ও নানা কারণে মিঃ টিলম্যান হেঙ্কেল প্রতিষ্ঠিত থানা ১৮৮২ সালে সরকার বন্ধ করে দেন। এ সময়ে মির্জানগর-ভূষণা-ধর্মপুর ও নয়াবাদে চারটি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আঠার শতকের শেষের দিকে রূপসা খালের পূর্বদিকে খুলনায় ইংরেজদের লবণ চৌকির থানা স্থাপনকালে রূপসা খাল (পূর্ব নাম জানা যায় না) ভৈরব থেকে মাথাভাঙ্গার ওখানে কাজিবাছা ও ময়ুর নদীর মিলিত স্থান পর্যন্ত একটি মরা খাল ছিল। পশুর নদী উত্তরে সরে এসে কাজীবাছা নাম নিয়ে পূর্বোক্ত জায়গা থেকে সরাসরি ডাইনে ঘুরে গেছে। নদীর এই ঘোরান বাঁককে মাথাভাঙ্গা বলে। নদী পথে ভৈরব আসতে গেলে আরো অনেক ঘুরে যাত্রাপুর হয়ে ভৈরব দিয়ে এখানে আসতে হতো এবং এর জন্যে প্রায় দেড় দিন সময় লেগে যেত। রূপসার এই মরা খালের জন্যে নদী পথের দূরত্ব সংক্ষিপ্ত ও লবণ বোঝাই নৌ-বহর সহজ পথে চলাচল করার জন্যে নড়াইলের জনৈক লবণ ব্যবসায়ী রূপলাল সাহা ভৈরব থেকে মাথাভাঙ্গা পর্যন্ত এই মরা খালের মাঝে একটা সরু খাল কেটে দেন। এ খাল রূপলাল সাহার খাল বলে কথিত হোত এবং কালক্রমে প্রবল স্রোতে প্রশস্ত হয়ে রূপসা নামে পরিচিত হয়। রূপসার কাটাখাল প্রথম দিকে খুব সরু থাকায় লোক বাঁশের সাকো দিয়ে পারাপার হোত ভৈরব ও আঠারবাকীর মিলিত স্রোত এই খাল দিয়ে পশুর নদীতে প্রবাহিত হবার সহজ পথ পেয়ে ক্রমে স্ফীত ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ভূ-কৈলাশের রাজা কালীশঙ্কর ঘোষালের কাছ থেকে বরিশালের গুরুধামের কাছারীর ম্যানেজার কামরুন সাহেবের স্ত্রী মার্গারেট হোগলা পরগনার (খুলনার অত্র এলাকা) চার আনা অংশ কবলামূলে প্রাপ্ত হন। মার্গারেটের একমাত্র কন্যা ও উত্তরাধিকারী বারবারাকে বিবাহ সূত্রে গত শতকের ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে বৃটিশ সেনাবাহিনীর ভাগ্যন্বেষী সেনা উইলিয়াম হেনরী সেনিড রেণী উক্ত সম্পত্তির ট্রাষ্টী নিযুক্ত হয়ে বর্তমান খুলনা শহরের উত্তর-পুবদিকে রূপসা খালের পুবদিকে তালিমপুর গ্রামের উত্তরাংশে ভৈরব নদীর তীরে কুঠি স্থাপন করে বসবাস শুরু করেন। রেণী সাহেব সরকারের কাছ থেকে রূপসার চর ও লখপুরের জমিদারের কাছ থেকে খুলনা, এলাইপুর গ্রাম বন্দোবস্ত নিয়ে নীল ও চিনির ব্যবসা শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যে অনেকগুলো নীল ও চিনির কুঠি স্থাপন ও নীলকর সাহেবদের চারিত্রিক অভ্যাসগত প্রজাদের জোর পূর্বক দাদন দেওয়া, নীলচাষে বাধ্য করা, বেগার খাটান ইত্যাদির দ্বারা সাধারণ অধিবাসীদের অতিষ্ঠ করে তোলেন। রেণী সাহেরে অত্যাচারের অনেক প্রবাদ কাহিনী এখনও এ অঞ্চলের লোকমুখে শোনা যায়। তার অত্যাচারে কুঠির পাশের রাস্তা দিয়ে কোন লোক চলতে ইচ্ছুক হোতনা। উল্লেখ্য সমৃদ্ধ জনপদগুলি তখন এ অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হলে, পার্শ্ববর্তী শ্রীরামপুরের প্রভাবশালী তালুকদার ও নীল ব্যবসায়ী শিবনাথ ঘোষ নিকটবর্তী তালুকদার ও প্রভাবশালী লোকদের সাথে পরামর্শ করে রেণী সাহেবের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন। অপর দিকে খুলনার অপর পারের দিননাথ সিং রেণী সাহেবের পক্ষে যোগ দেন। ফলে প্রায় দু’দলের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ মাঝে মাঝে তীব্র হয়ে ছোট খাট যুদ্ধে রূপ নিতে শুরু করে। এসব ঘটনা নিবৃত্ত কল্পে ইংরেজ সরকার ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে পুরাতন খুলনা থানা পুনঃ সংগঠিত করে উভয়ের বাড়ীর মাঝামাঝি কিসমত খুলনা মৌজায় খুলনা গ্রাম সংলগ্ন নয়াবাদ গ্রামে খুলনা নামে নতুন থানা স্থাপন করেন। (কেউ কেউ বলেন, থানা স্থাপন কালে এ জায়গার জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদ করা হয় বলে এখানের নাম হয় নয়াবাদ। প্রকৃতপক্ষে এখানে ঐ নামে বহু পূর্ব থেকে একটা গ্রাম ছিল। নয়াবাদ শব্দকে অর্থবোধক কারণে এ ধারণার সৃষ্টি বলে অনুমিত হয়।) রেণী সাহেব ও শিবনাথ ঘোষের ক্রমাগত সংঘর্ষ প্রচণ্ডতর হলে এ থানা অকার্যকর হয়ে পড়ে। যশোর সদর থেকে এতো দূরত্বে এদের সংঘর্ষ দমন সহজ নয় বিবেচনা করে ইংরেজ সরকার যশোর সদর অধীন একজন ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ ও সাবডিভিশন গঠনের উদ্যোগ নেন। ইংরেজ সরকার ১৮৪২ খ্রীঃ এখানে একটা মহকুমা (Subdivision) গঠন করে মিঃ এম, এ, জি. শো-কে মহকুমা প্রশাসক (S. D. O) নিযুক্ত করেন। মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেট নয়াবাদ থানার পশ্চিম পাশে রেণী সাহেবের কুঠিরের কাছেই তাবুতে প্রথম মহকুমার কাজ শুরু করেন এবং নয়াবাদে অবস্থিত খুলনা থানার নামেই নবগঠিত মহকুমার নামকরণ হয় খুলনা মহকুমা। খুলনা বাংলায় ইংরেজ শাসনের প্রথম মহকুমা। ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে এ থানা মহকুমা সদরের পাশে বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়।
কুঠিরের দোর গোড়ায় মহকুমা প্রশাসকের কাছারির জন্য রেণী সাহেব একদিকে তার স্বেচ্ছাচার মূলক কাজে লেঠেলের অবস্থান, দাদনী ও নীল চাষে বৈরী প্রজা কয়েদ ইত্যাদির গোপনীয়তা রক্ষায় সংশয়াপন্ন ও বিব্রত হয়ে ওঠেন, অপর দিকে শিবনাথ ঘোষ স্বজাতি মহকুমা প্রশাসকের অবস্থান ও কাছারী স্থাপনে স্বাভাবিক পক্ষপাতিত্বের আশংকায় কাছারী অন্যত্র কোথাও সরিয়ে দেয়ার জন্যে সচেষ্ট হন। উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন চেষ্টায় ও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হবার ভয়ে কয়েক মাস পরে বর্ষারম্ভের পূর্বে মহকুমা কাহারী রূপসা খালের পশ্চিমে ভৈরব ও রূপসার মিলিত স্থানের দক্ষিণ-পুরে ও মির্জাপুর মাঠের উত্তর পুব কোণে নদীর পাড়ে উঁচু জায়গায় খড়ের ঘরে পূর্বোক্ত মহকুমা কাছারী ও প্রশাসকের বাসস্থান স্থানান্তরিত হয়ে মহকুমা সদরের ভিত্তি স্থাপিত হয়। নদীর পাড়ের এ জায়গা কাছারী নির্মাণকালে উঁচু ও উলুখড়ের বন ছিল বলে জানা যায়। কারো মতে মির্জাপুর মাঠের উক্ত জায়গা টুটপাড়া গ্রামের একাংশ। টুটপাড়া গ্রাম এখান থেকে বেশ দূরে এবং শুধু এ জায়গা নয়, এরও পার্শ্বস্থিত অনেক দূর পর্যন্ত মির্জাপুরের মাঠ বিস্তৃত ও কাছারির নিকটের জনবসতি মির্জাপুর বলে পরিচিত ছিল। সুতরাং উক্ত ধারণায় কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। যা হোক, রেণী সাহেব ও শিবনাথ ঘোষ ষড়যন্ত্র করে মহকুমা প্রশাসককে নিম্নাঞ্চল, অস্বাস্থ্যকর ও ম্যালেরিয়া ভীতি দিয়ে যে স্থানে সরিয়ে নিয়ে ছিলেন, সে জায়গা পূর্বের জায়গা থেকে কোন দিক দিয়েই স্বাস্থ্যকর বা ম্যালেরিয়া মুক্ত ছিল না। রেণী ও শিবনাথ ঘোষের আজ শুধু স্মৃতির চারণ ক্ষেত্র নয়, অধিকন্তু তাদের এই লড়াই ও ষড়যন্ত্রের ফসল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প ও বন্দর বৃহত্তম শিল্প ও বন্দর নগরী রূপে বিশ্বে পরিচিত।
মহকুমা সদরের পরিচিতি
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন মহকুমা সদরের পরিচিতি
মির্জাপুর মাঠ, কয়লাঘাট থেকে সাউথ সেন্ট্রাল রোড, সারদাবাবু রোড পর্যস্ত এবং সারদাবাবু রোড থেকে ফেরী ঘাট রোড, ফেরীঘাট রোড পঞ্চবীথি হয়ে যশোর রোড ও যশোর রোড ডাকবাংলা হয়ে হেলাতলার পুবদিকে নদীর তীর পর্যন্ত মির্জাপুর বলে কথিত হোত। বর্তমান মির্জাপুর নামে পরিচিত বিস্তীর্ণ এলাকা তৎকালে মির্জাপুর মাঠের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম ভাগে ছিল। ফেরীঘাট রোডের দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের জনবসতিপূর্ণ জায়গাগুলো নির্দিষ্ট এক একটা গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। ফেরীঘাট রোড ও দীনবন্ধু ঘোষ রোড, সাউথ সেন্টাল রোড এবং রূপসা খালের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা নীচু অনাবাদী জমি ছিল। বছরের অধিকাংশ সময় এই জমির অনেকাংশ পানির নীচে থাকতো। বাকী অংশে অবস্থান ভেদে কিছু কিছু ধানের চাষ হোত। উল্লেখ্য বিগত তিন দশক ধরে ক্রমাগত জনসংখ্যার চাপে শহরে বাসস্থান সংকটের জন্যে পুকুর কেটে উল্লেখিত নীচু ও আবাদী জমি ভরাট করে বাসোপযোগী করা হয়েছে এখন এ এলাকা দেখলে পূর্বের অবস্থা অনুমান বরা যায় না তবে বর্ষাকালে এলাকার নীচু জায়গা ও রাস্তা পানিতে ডুবে যায়।
আলোচিত মির্জাপুর মাঠের বিস্তীর্ণ এলাকা মোটামুটি বাসোপযোগী ছিল। মহকুমা সদর স্থাপনকালে অপেক্ষাকৃত নদীর উঁচু তীর ধরে কয়েকটা মুসলমান পরিবার, বাইতী ও পরামানিকের বসতি এবং তার দক্ষিণে পঞ্চনীথি এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায় ও পশ্চিম সহ উত্তর পশ্চিম অংশে মুচিদের সংঘবদ্ধ বাস ভিন্ন মির্জাপুর মাঠের সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে বুনোদের (আদিবাসী) বসবাস ছিল। এ ছাড়া মির্জাপুর মাঠের মধ্যে অন্য কোন বসতির সন্ধান পাওয়া যায় না । আঠার শতকের গোড়ার দিকে মির্জাপুর মাঠ ও তার পার্শ্ববর্তী বেনেখামার, হেলাতলা শিববাড়ীসহ আরো কিছু জনপদ জনশূন্য হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, রাজনৈতিক ও দস্যুতস্করের উপর্যুপরি হামলা এর কারণ বলে অনুমিত হয়। বেশ কিছুদিন পরে পুনরায় এই সব এলাকায় বসতি গড়ে উঠতে থাকে এবং স্থান বিশেষ নতুন বসতির ফলে নাম করণে নতুন করে পরিচিত হয়। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও নিরাপত্তা জনিত কারণে কোথাও কোথাও পুনঃ বসতি আর গড়ে ওঠেনি।
নবগঠিত মহকুমা সদরের কাছে পশ্চিমে বাঁশদহের কাজী সাহেবদের বসত বাড়ী (বর্তমান টাউন মসজিদের জায়গা) ও তারও পশ্চিমে জেলাজজ আদালতের পুবদিকে জজ সাহেবের কুঠির এলাকায় বাবুখান সাহেবদের বাড়ী ছিল। আদালত ভবনের জায়গায় বাবু গঙ্গাচরণ সেনের বসতি ছিল বলে জানা যায়। কংগ্রেস নেতা বাবু গঙ্গাচরণ সেন (নগেন সেনের পিতা) তারও পশ্চিমে নদীর পাড় ধরে সেনের বাজার এলাকা থেকে উঠে এসে পরামানিক ও বাইতি এবং উত্তর-পশ্চিম কোণে দেয়াড়া ও ডুমুরিয়া থেকে উঠে আসা মুচিদের (ঋষি সম্প্রদায়ের লোক) বাস ছিল। মির্জাপুর মাঠের সম্ভ্রান্তীয়দের বসতি এলাকার মধ্যে কিছু ফলের বাগান ও নদীর অপর পারের সমৃদ্ধ জনপদের ও লবণ এজেন্সীর লোকদের আম কাঠালের বাগান ছাড়া বাকী জায়গা ঝোপঝাড় ও আগাছায় পূর্ণ ছিল। বুনোরা বসতির সময় এই সব ঝোপঝাড় সাফ করে সামান্য তরিতরকারী ও আখের চাষ করতো।
খুলনা-যশোরে বেশ কয়েকটা মির্জাপুর নামের গ্রাম দেখা যায়। এই মির্জাপুর নামের গ্রামগুলির পরস্পরের সম্পর্ক নির্ণয় করা কঠিন, তবে বারভূঁইয়াদের অন্যতম মহারাজ প্রতাপাদিত্যের যশোর রাজ্য মোঘল অধিকার ভুক্ত হলে (১৬০৪ খ্রীঃ) একজন ফৌজদার কর্তৃক এ রাজ্য শাসিত হয়। এ সময় ফৌজদার ও সুবেদারদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে তাদের অনুগৃহীত ব্যক্তিগণ ছোট ছোট জায়গীর বা পত্তনি নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। মির্জা উপাধিযুক্ত মোঘল বসতির বা জায়গীরগুলো কোথাও মির্জাপুর কোথাও মির্জানগর নামে পরিচিত হয় বলে সাধারণভাবে ধারণা করা হয়।
একটা পুরনো দলিল সূত্রে জানা যায় জনৈক মহম্মদ ফয়জুল্লাহ যশোরের খড়কিতে বসবাসরত মির্জা লাল মহম্মদের কোন ওয়ারেশ এর কাছ থেকে এখানে নদীপাড়ের শিববাড়ী এলাকার কিছু সম্পত্তি খরিদমূল্যে প্রাপ্ত হয়ে বসতি করেন এবং বসতি এলাকার নাম দেন মিয়া বাগ। উক্ত দলিলে মুদাফত মির্জা লাল মহম্মদের নাম উল্লেখিত হওয়ায় ধারণা করা চলে যে, অত্র এলাকা মির্জা লাল মহম্মদের পত্তনি বা জায়গীরভুক্ত ছিল। সম সময়ে এখানে কিছু মির্জার বসতি হয়। মির্জা লাল মহম্মদ যশোরের মোঘল ফৌজদার নূর-উল্লাহ খাঁর জামাতা ও প্রধান সেনাপতি ছিলেন। নূর-উল্লাহ খাঁ ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে ভদ্রা ও হরিহর নদীর মোহনায় ত্রিমোহনীতে কয়েকটি এলাকার ফৌজদার ও তিন হাজারী মসনবদার হিসেবে নবাবের মত বসবাস করতেন। লাল মোহাম্মদ একজন সিপাহী হিসাবে নূর উল্লাহর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যে নিজের প্রতিভার গুণে ফৌজদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নূর-উল্লাহ খাঁ এই প্রতিভাবান যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে সেনাপতিতে উন্নীত করেন ও মেয়ের সাথে বিয়ে দেন। লাল মোহাম্মদ দীর্ঘদিন যাবত সেনাবিভাগের দায়িত্ব পালন ও শ্বশুরের সাথে শাসন কাজে সহায়তা করেন। নূর উল্লাহর কর্মচারী রাজা রাম সরকারের কন্যার সাথে লাল খাঁর অপূর্ব এক প্রেম কাহিনী আজও মনিরাম ও কেশবপুর অঞ্চলে লোকমুখে শোনা যায়। সেনহাটিতে লাল খাঁ কর্তৃ ক খনিত বিরাট জলাশয় ‘লাল খাঁর দীঘি’ বা ‘সরকার ঝি’ নামের স্মৃতিবহন করছে। নূরউল্লাহ খাঁর একপুত্র পরে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। নূরউল্লা খাঁ ও লাল খাঁর বংশধরেরা পরবর্তীকালে যশোরের খড়কি অঞ্চলে বসবাস করেছিলেন বলে জানা যায়। উল্লেখ্য শিববাড়ীর পশ্চিম পাশে নূরনগর গ্রাম ফৌজদার নূর উল্লাহ নামের স্মৃতি বহন করছে।
কথিত মির্জাপুর মাঠের মধ্যে কোথাও প্রাচীন বাড়ীর চিহ্ন বা কোন ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায় না। তবে বর্তমান মির্জাপুর এলাকায় পাঁচু বুনোদের বসতির পূর্বদিকে সি, এস ম্যাপে উল্লেখিত মির্জাপুর রোড নামে সরু আঁকা বাঁকা একটা পায়ে চলার রাস্তার পাশে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় পাতলা টালি ইটের খিলানযুক্ত মাটি সমান একটা পাকা কবরের চিহ্ন ছিল।
এ রাস্তার উত্তর পাশের প্রায় সব জমি বাগেরহাটের দশানীর জমিদার ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের দখলি থাকায় দক্ষিণপাশ দিয়ে কিছু জমি ছেড়ে সাধারণ চলাচল উপযোগী প্রশস্ত করে নেন। এ রাস্তায় উভয়পাশে মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠাকালে বা তার নিকটবর্তী সময়ে কয়েকঘর বুনো ছাড়া অন্য কোন লোকের বাস না থাকায় স্বাভাবিকভাবে এ কবরের কোন পরিচয় ছিলনা। তবে বুনোরা অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে ইটের গাঁথুনি ও তার পাশে বড় একটা করবীফুলের গাছের জন্যে জায়গাটা সম্মানের চোখে দেখতো। জেলা শহর প্রতিষ্ঠার পর এ জমির উত্তর পূর্ব দিকের জমিতে জমিদারের কাছারী হিসেবে একটা গোলপাতার ঘরে একজন নায়েব বাস করেন। সমসময়ে এ রাস্তার পাশে আরও অনেকে বসবাস শুরু করেন কিন্তু কেহই এ বিষয়ে কোন ঔৎসুক্য প্রকাশ করেননি। ১৯২১/২২ সালে কবরের উত্তর পাশে একজন মুসলমান আইনজীবী (লেখক পিতা) একটা বাড়ী খরিদ করে বসবাসকালে কবরটি দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্তু পরিচয় বিহীন কবরটি পূর্ব অবস্থায় থাকে। এই জমিসহ পাঁচুদের সমস্ত জমির মালিকানা জমিদারদের হাতে চলে যায়। অবশ্য এই কবর ও তার পাশের উচু জায়গা কেউ কোন ভাবে ব্যবহার করতোনা। ষাটের দশকে এজমি বিক্রীত হয়ে নতুন বাড়ীর ভিত খনন কালে অজ্ঞতা প্রসূত কারণে প্রাচীন স্মৃতির এই কবরটি ভিতের তলায় শেষ পরিণতি লাভ করে। পাকা কবরের অবস্থিতির জন্যে বোঝা যায় যে, এক সময়ে এখানে মুসলিম বসতি এবং এ কবর কোন সঙ্গতিপন্ন পরিবার প্রধানের ছিল ও তার বাসস্থান নিকটে কোথাও হওয়া স্বাভাবিক। উল্লেখিত কারণে এ ধারণা অমূলক নয় যে ত্রিমোহনী ও মির্জাপুরের মুঘোলদের সাথে এ অঞ্চলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল এবং মির্জা লাল খার দ্বারাই মির্জাপুরের পত্তন ও নামকরণ হয়েছিল। পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, আঠার শতকের গোড়ার দিকে (১৭১০ খ্রী:) যশোর ফৌজদারী তুলে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া যায়। সঙ্গত কারণেই সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসন ব্যবস্থা অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফৌজদার নূরুল্লা খা যশোর থাকা কালে সুবেদার শায়েস্তা খান দুর্ধর্ষ মগ ফিরিঙ্গী দস্যুদের দমন ও বাংলা থেকে বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। বিস্তীর্ণ সুন্দরবন অঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকা দস্যুরা সুযোগ বুঝে সহজ নদীপথে এসে লোকালয়ে আক্রমণ ও লুণ্ঠন অনেকদিন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিল। এ ছাড়াও ওই শতকের মাঝামাঝি দক্ষিণ বঙ্গে মারাঠা দস্যুদের আক্রমণ বাখেরগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল বলে জানা যায়। সুতরাং এসব দস্যুদের হাত থেকে এ অঞ্চল মুক্ত ছিল সন্দেহাতীতভাবে এ কথা বলা কঠিন। তবে যে কোন কারণে হোক এ জায়গা জনশূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এই জনশূন্য ও ফাঁকা জায়গা নিকটবর্তী জনপদের কাছে মির্জাপুরের মাঠ বলে কথিত ও পরিচিত হয়।
এই মির্জাপুর মাঠের উত্তর পুর্ব কোণেই মহকুমা প্রশাসকের অফিস বাসস্থানের জন্য খড়ের ঘর ভুলে যেখানে প্রথম কাজ করা হয়, সে যায়গায় ফাঁকা ও উলু খড়ের বন ছিল। ১৮৪৫ সালে এখানে মহকুমা প্রশাসকের দপ্তর ও বাসস্থানের জন্যে প্রথম পাকা দালান নির্মিত হয়। এই দালান শহর এলাকার প্রথম সরকারী পাকা বাড়ী ও রেল এলাকা সহ শহর মধ্যের দ্বিতীয় পাকা বাড়ী। বর্তমানে এই থাকাবাড়ী জেলা প্রশাসকের বাসস্থানরূপে ব্যবহৃত।
মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠার জন্য মহকুমা প্রশাসকের বাসভবনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা নতুন রাস্তা পশ্চিম দিক বরাবর বর্তমান জেলাজজ আদালত ও কালেক্টরেট ভবনের মধ্যবর্তী রাস্তা পর্যন্ত নির্মিত হয়। এ সময় বর্তমান জেলখানা ঘাটের এখানে ভৈরব নদীর পারাপারের একটা ঘাট ছিল এবং ঘাট সোজা দক্ষিণমুখী টুটপাড়া পর্যন্ত একটা চলাচলের রাস্তা ছিল। নহকুমা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে থেকে নতুন রাস্তা এই রাস্তার সাথে সংযোগ করে দেয়া হয়। নদীর পাড় থেকে এই দুই রাস্তার মধ্যবর্তী এলাকা নিয়ে প্রথম মহকুমা সদর গঠিত হয়। মহকুনা সদরের পশ্চিমদিকে বর্তমান জেলাজজ আদালতের পুবদিকে অপর একটা খড়ের ঘরে মুনসেফ আদালতের কাজ শুরু হয়। এর পশ্চিমদিকে বৰ্তমান টাউন জামে মসজিদ এর এখানে বাঁশদহের কাজি সাহেবদের বাড়ী ও তার পাশে মুনসেফ আদালতের জায়গায় ছিল বাবুখান সাহেবদের বাড়ী। সদর প্রতিষ্ঠাকালে এদের বাড়ী ও সম্পত্তি হুকুমদখল করা হয়। কাজি সাহেবরা জমি বাড়ী হুকুমদখলের পর উঠে এসে নিকটবর্তী মুন্সি পাড়ায় ও বাবুখান সাহেবরা সাউথ সেন্টাল রোড এবং বাবুখান রোডের মিলিত স্থানের দক্ষিণ পুবকোণে (বর্তমান পাইওনিয়র মহিলা মহাবিদ্যালয়) বসতি করেন। এ জায়গা তখন টুটপাড়া গ্রামের অন্তর্ভুক্ত ও উত্তর সীমানা ছিল। এবং এখান থেকে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ টুটপাড়ায় গিয়ে বাস করেন। এছাড়া গঙ্গাচরণ সেন মহাশরের মহকুমা সদরের পশ্চিমাংশে বর্তমান আদালত ভবন এলাকায় বসতির কথা শোনা যায়।
চার্লীগঞ্জের হাট
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন চার্লীগঞ্জের হাট
যশোর কোম্পানি শাসন (১৭৭২ খ্রী. প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের রায়মঙ্গল লবণ এজেন্সীর সদর দপ্তর ১৭৮১ সালে বর্তমান খুলনা শহরের কয়লাঘাটায় স্থানান্তরিত হয় লবণ এজেন্সীর ডেপুটি ছিলেন জনৈক চার্লস সংক্ষেপে চার্লী সাহেব। খুলনা ষ্টেশনের উত্তরপুর দিকে চার্লীসাহেব তার কুঠি স্থাপন করেন ও কুঠির পুবদিকে নদীর পাড়ে এক হাট বসান। এই হাট চার্লীগঞ্জের হাট বা সাহেবের বাজার এবং কুঠিসহ হাটের পার্শ্বস্থ জায়গা লোকমুখে চার্লীগঞ্জ বলে পরিচিত হয়। অন্য মতে খালিশপুরের পুবদিকে (বর্তমান রেল এলাকাসহ) জনৈক চোলেট সাহেবের একটা নীলকুঠি ছিল। এই কুঠির নিকটে তিনি একটা হাটের পত্তন করেন। লোকে চোলেট সাহেবকে ভুল করে চার্লীসাহেব বলতে। এবং তার নামে হাটের নাম চার্লিগঞ্জের হাট হয়। ১৮০২ সালে জনৈক চার্লস শহরের পাশে নিলকুঠি স্থাপন করেন। উল্লেখ্য খুলনার দৌলতপুরে প্রথম নীলচাষ ও নীলকুঠি স্থাপন করেন জনৈক ইংরেজ এণ্ডারসন ১৮০১ সালে। চার্লী সাহেবের কুঠি বাড়ীটি কয়েকদফা সংস্কারের পর বর্তমানে রেলওয়ে কর্মচারীদের বিশ্রামাগার রূপে ব্যবহৃত। এই কুঠি বাড়ীটি এলাকার প্রথম পাকাবাড়ী। চার্লী সাহেবের নাম ও সঠিক পেশা নিয়ে যতই বিতর্ক থাক তার ডাক নাম, কুঠি ও হাটের অবস্থান নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।
মহকুমা সদরের নিকটের বসতি গুলোর মধ্যে সদরের আধমাইলের সামান্য দূরে চার্লীগঞ্জের হাট ছাড়া কোন হাট বাজার ছিলনা। বর্তমান বড়বাজারের মুরগীহাটের বটগাছ তলায় শনি ও বুধবারে এ হাট হতো। এই হাটের কেন্দ্র ও পার্শ্ববর্তী স্থান চার্লীগঞ্জ বা সাহেবের হাট নামে পরিচিত ছিল। চার্লীগঞ্জ স্থানীয় সাধারণ হাট ছাড়া রেললাইন ও ষ্টিমার সার্ভীস চালু হওয়া পর্যন্ত কোন বড় ব্যবসাকেন্দ্র ছিলনা। এ সময়ে নিকটবর্তী বড় ব্যবসাকেন্দ্র হিসাবে সদর থেকে প্রায় একমাইল পুরদিকে ভৈরব নদীর অপর পারে সেনের বাজার বিখ্যাত ছিল। ভৈরব নদের ভয়াবহতা এবং অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় বিশেষ প্রয়োজন ভিন্ন এ হাটে সচরাচর এ দিকের লোক বেশী যেতনা ও চার্লীগঞ্জের হাট বসার আগে খালিশপুরের পাশে চরের হাট ও বয়রার হাট প্রধান ছিল।
বসতি
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন বসতি
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, মির্জাপুর মাঠের মধ্যে মহকুমা সদর বাদে নদীর পাড় ধরে কয়েক ঘর বাইতি ও পশ্চিমে পরামানিক ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মুচিদের বসতি ছাড়া সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে বুনোদের বাস ছিল। বাইতিরা ভৈরব নদীর ওপার থেকে এসে এখানে বসতি করে। নদীর ওপারে তাদের বসতি এলাকা এখনও লোকে বাতীভিটা বলে অভিহিত করে। সুন্দরবন থেকে চোঙ (এক প্রকার শামুক) সংগ্রহ ও চুন তৈরী করে সেনের বাজারের সাথে ব্যবসায়িক কারণে নদীর ওপারে বাজারের নিকট বসতি স্থাপন করে। সুন্দরবন থেকে সংগৃহীত চোঙের পচা গঞ্জের জন্যে লোকালয় থেকে দূরে নদীর এপারের সুবিধাজনক ফাঁকা জায়গায় নতুন করে বসতি স্থাপনে আকর্ষিত করেছিল।
কয়েকজন প্রবীণ বাইতীও এ ধরনের মত প্রকাশ করেন। অন্যমতে নীল কুঠিতে প্রচুর চুনের প্রয়োজন হতো। একারণে বাইতীদের নীলকুঠির কাছে চলে আসা অস্বাভাবিক নয়।
পরামানিকেরাও জমি ও চার্লীগঞ্জে ব্যবসায়ের জন্য অধিকাংশ নদীর ওপার ও সেনের বাজার এলাকা থেকে এসে বসতি করে। বাইতি ও পরামানিকদের অনেক আগে থেকে মির্জাপুর মাঠের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে (ডাক বাংলা মোড় থেকে যশোর রোড়, ফেরীঘাট রোড ও সিমেট্রী রোডের মধ্যবর্তী স্থান) মুচিদের বসতি। জনশূন্য মির্জাপুর মাঠে নদীর ওপার দেয়াড়া ও ডুমুরিয়া অঞ্চল থেকে মুচিরা সম্ভবতঃ প্রথম বসতি গড়ে তোলে। মির্জাপুর মাঠের মুচিদের বসতি অংশ কোন গ্রাম বা নামে পরিচিত ছিলনা। এখানের মুচিরাও দেয়াড়া ও ডুমুরিয়ার স্বগোত্রীয়দের মত মরা পশুর চামড়া সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাঁশ বেত দিয়ে ধামা, কুলো, ডালা ইত্যাদি তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করত। মুচিদের উৎপন্ন মালামাল চার্লীগঞ্জে বিক্রয় ও ব্যবসায়িক কারণে এ এলাকায় তাদের বসতির প্রধান কারণ।
বাগদী বা বুনো
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন বাগদী বা বুনো
এছাড়া বুনো বা বাগদিদের বসতি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। মির্জাপুর মাঠ ছাড়া নিকটবর্তী ভৈরব তীরে আর কোথাও এত বেশী বুনোদের একত্রে বসবাস দেখা যায় না।
অবশ্য একট লক্ষ্য করলে ভৈরব, মধুমতি ও কপোতাক্ষ তীরে ইংরে সরা যেখানে ব্যবসায় বা নীলকুঠি করেছিল তার পাশে দু’চার ঘর বুনোদের বাস দেখা যায় এবং এদের বুনো বলে অভিহিত করার কারণও স্পষ্ট নয়। কেউ কেউ বলেন, খুলনা পৌরসভা গঠিত হলে মির্জাপুর মাঠের জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য পৌরসভার চেয়ারম্যান ডাঃ কে, ডি, ঘোষ এদের বিহার থেকে এনেছিলেন। কিন্তু এখানে পৌরসভা প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই বুনোদের বাস ছিল। মূলতঃ গঙ্গার শাখা পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর মধ্যবর্তী ত্রিকোনাকৃতি ভূ-খণ্ডকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বলা হত। বৌদ্ধ আমলে এই ব-দ্বীপ অঞ্চল বাগদি নামে পরিচিত ছিল এবং সেন রাজত্বকালে এ প্রদেশের রাজনৈতিক নাম হয় বাগদি বা বাগড়ী। বাগদী বা বাগড়ীর প্রাচীন বাসিন্দাদের বাগদী নামে আখ্যাত করা হত। এতদাঞ্চলের সুন্দরবনের নিকটবর্তী সাতক্ষীরা ও পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ- হিঙ্গলগঞ্জ-সন্দেশখালী-বাসন্তি ও ক্যানিং এর গ্রামাঞ্চলে এদের অধিক বাস দেখা যায়। এই সব অঞ্চলে স্থানীয় ভাবে বাগদীরা বুনো বা আদিবাসী নামে পরিচিত। বাগদী বা বাগড়ীরা স্বতন্ত্রভাবে বনের কাছাকাছি বসবাস ও বন্য পশু শিকার করে খেতো বলে অন্যেরা এদের বুনো নামে অভিহিত করে।
বুনোরা সরল বিশ্বাসী ও পরিশ্রমী বলে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তাদের কুঠির বিভিন্ন কাজে এদের নিয়োগ করতো। রায়মঙ্গল লবণ এজেন্সীর সদর দফতর (১৭৮১ খ্রীঃ) খুলনায় কয়লাঘাটায়) স্থানান্তর কালে এজেন্সীর বিভিন্ন কাজের জন্য এদের নিয়ে আসা হয় ও মির্জাপুর মাঠের বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গায় এদের বসতি হয়। পরবর্তীতে অন্যান্য ব্যবসা ও নীলকুঠিতে ইংরেজরা এদের নিয়োগ করত। ইংরেজ কুঠি উঠে গেলেও কুঠির পাশে তাদের আনিত আদিবাসী বুনোদের বাস উঠে যায়নি। তারা স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে মিলে মিশে রয়ে গেছে। এ কারণে পরিত্যক্ত ইংরেজ কুঠিরের পাশে এদের বিক্ষিপ্ত বাস দেখা যায়। বুনোরা বন্য পশু ও কচ্ছপ শিকার এবং মাটি কাটার কাজে খুব দক্ষ ছিল।
মির্জাপুরের পাশের বসতি-হেলাতলা
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন মির্জাপুরের পাশের বসতি-হেলাতলা
এ ছাড়াও মির্জাপুর মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে ঋষিদের বসতির দক্ষিণে (বি, কে, স্কুল পার্শ্ববর্তী পঞ্চবীথি কবরখানা রোড) কয়েকটি মুসলিম পরিবারের বাস ছিল। অবশ্য পূর্ব থেকেই বেনেখামার মুসলিম বসতিপূর্ণ গ্রাম ও এ অংশ বেনে খামার গ্রামের উত্তর পূর্ব কোণে অবস্থিত বিধায় এ সময়ে সঠিক গ্রাম সীমানার অভাবে নির্দিষ্ট করে কোন এলাকাধীন বলা কঠিন। তবে মির্জাপুর মাঠ এলাকা হওয়া স্বাভাবিক।
চার্লীগঞ্জ বা সাহেবের হাটের পূর্বে ও মির্জাপুর মাঠের পরামানিকদের বসতির পশ্চিম পাশে হেলাতলার অবস্থিতি রয়েছে। বর্তমান সময়েও হেলাতলা ও হেলাতলার মোড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা ও রাস্তার আধিক্য এক সময়ের ঘন বসতির আভাস দেয়। হেলাতলা খালিশপুর পরগনা অধীন মৌজা। মৌজা গঠনকালে মৌজাধীন প্রধান জনপদ বা সর্বজন পরিচিত কোন নামে মৌজার নামকরণ করা হোত যাতে সহজে মৌজার অবস্থান বোঝা যায়। এভাবে ভাবতে গেলে মৌজা গঠন কালের পূর্বে এখানে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল বলে অনুমান করা যায় ও হেলাতলার মোড় ব্যবহৃত কথাও এখানে বসতির ইংগিত পাওয়া যায়। সম্ভরতঃ ভৈরবের দু’পাশ দিয়ে যখন বৈদ্য-কায়স্থ গ্রামগুলো গড়ে উঠেছিল সে সময় হেলাতলায় অনুরূপ বসতি ও গ্রাম গড়ে ওঠে। হেলাতলা নামের উৎপত্তির সঠিক কারণ জানা যায় না তবে হেলাতলা থেকে হেলাতলায় উদ্ভব বলে মনে হয়। অঞ্চলে হেতালবুনিয়া, হেতালতলা ইত্যাদি নামে অনেক গ্রাম আছে। সাতক্ষীরার নিকটে প্রাচীন সমৃদ্ধ গ্রাম হেতালতলার সাথে এখানের কোন সম্পর্ক ছিল কিনা বোঝা যায় না। মির্জাপুর সহ পার্শ্ববর্তী এলাকার জনবসতি শূন্য হওয়ার সময় ওই কারণে ও সময়ে সম্ভবতঃ হেলাতলা জনবসতি শূন্য বা হালকা হয়ে পড়ে। পরবর্তী বসতি চার্লীগঞ্জের হাটের দক্ষিণ দিকে রেল লাইন বসানোর সময় পূর্বে ক্লে রোড পর্যন্ত রেলসীমানা ও রেল বসানোর পর বাজার সম্প্রসারিত হয়ে পূর্বদিকে সরে এলে অবশিষ্ট হেলাতলা তুলশীতলায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পূর্ব দিকের সামান্য অংশ ও নামের স্মৃতি উত্তরসূরীদের জন্যে রেখে যায়। উল্লেখ্য কাঠালতলা তালতলা-ফুলতলা-হিজলতলা ইত্যাদি তলা যুক্ত নামের গাছের তলা বুঝায় এবং এ ক্ষেত্রে হেতালতলা থেকে হেলাতলা হওয়া স্বাভাবিক।
হেলাতলার রথ নামে পরিচিত একখানা প্রাচীন রথ ও নদীতীরে জগন্নাথ মন্দির হেলাতলার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সন্ধেহমুক্ত করতে সহায়তা করে। এই জগন্নাথ মন্দির বর্তমান ঠাকুরবাড়ী গলির সোজা কাপড় পট্টিতে নদীর পাড়ে ছিল। মূল মন্দির ভাঙ্গনে নদী গর্ভস্থ হলে পূর্ব মন্দির সোজা দক্ষিণে সরে ক্ষুদ্রাকারে পুনঃ নির্মিত হয়। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি এ মন্দিরও নদী গর্ভ স্থ হয়। হেলাতলার রথ ও মন্দির কখন এবং কার দ্বারা নির্মিত হয় তা জানা যায় না। তবে মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠার পর চার্লিগঞ্জে নড়াইল জমিদারের তহসিল অফিস নির্মিত হলে কাছারীর নায়েব জোড়া মন্দিরের (শিববাড়ী) কাছ থেকে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রথখানা উদ্ধার করে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ও মেরামত করে কাছারির পাশে একটা টিনের ঘরে (ঘরটি রথ রাখার জন্য তৈরী) এনে রাখেন। রথ যাত্রা উপক্ষক্ষে এই রথ টেনে এনে হেলাতলার মোড়ে রাখা হত এবং কাছারির পুবদিকে চার্লিগঞ্জের হাটের বটতলার মেলার পত্তন করেন। ক্রমে এই মেলা বড় মেলায় রূপ নেয় এবং উল্টো রথের দিন হেলাতলার মোড়ে এই মেলা বসত। চার্লিগঞ্জের হাটে মেলার প্রচলনের পূর্বে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় এ মেলা হেলাতলার মোড়েই হত এবং নিকটে রথ রাখার ব্যবস্থা ছিল।
হেলাতলায় নববর্ষ উপলক্ষে ১লা বৈশাখ আরো একটা হেলার সন্ধান পাওয়া যায়। বহু আগে থেকে এখানে এ মেলা হোত। মেলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে বর্তমান শতকের গোড়ায় হেলাতলা মোড়ের নবাগত সোনা ও সুদের ব্যবসায়ী প্রতাপ চৌধুরী (পোদ্দার) চড়ক পুজো ও মেলার পুনঃ প্রবর্তন করেন।
হেলাতলার পূর্বদিকে ও মির্জাপুর মাঠের উত্তরে নদীর পাড়ে কালীবাড়ী বেশ পুরাতন। এই কালীবাড়ী কখন -কারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ও কোন জনবসতির কালীমন্দির ছিল তার কোন তথ্য বা এ সম্পর্কে কোন জনশ্রুতি শোনা যায় না। তবে কেউ কেউ মনে করেন, এ কালীবাড়ী এক সময়ের সমৃদ্ধ জনবসতি হেলাতলার কালীমন্দির। হেলাতলার বিবর্তনের সাথে কালীবাড়ীর সম্পর্ক নিবিড়। পররর্তী সময়ে এ এলাকার নতুন জনবসতি গড়ে ওঠার সাথে মন্দিরটা আবার প্রাণ ফিরে পায়। যতদূর জানা যায় গত শতকের মাঝামাঝি সেনহাটীর মহাদেব ঠাকুর মন্দিরের সেবাইত নিযুক্ত হন। যাই হোক বর্তমান কালীবাড়ীর মূল মন্দির বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে নদীর ভাঙ্গনে নদী গর্ভস্থ হবার উপক্রম হলে পূর্বের মন্দিরের দক্ষিণে ডাঃ ফনি রায়, রূপলাল নাগ, নগেন সেন (উকিল, কংগ্রেস নেতা), বসন্ত হালদার ও প্রসন্ন মিত্রের উদ্যোগে নতুন মন্দির নির্মিত হয়। বর্তমান মন্দির ও নদীর ভাঙ্গনে হুমকির সম্মুখীন। উল্লেখ্য স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কয়েকটা পাথরের মুর্তি এ মন্দিরে সংরক্ষিত ছিল।
মির্জাপুর মাঠের লাগোয়া জনবসতিপূর্ণ গ্রামগুলোর সাথে মির্জাপুরের বিবর্তনের সম্পর্ক নিবিড়। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী অনেক অবলুপ্ত বসতির নাম ও জনশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেয় প্রাচীন জনপদের। মহকুমা সদর থেকে জেলা সদরে রূপান্তরিত হওয়ার পর মির্জাপুর মাঠে নতুন করে গড়ে ওঠা বসতির জায়গায় সঙ্ক লান হয়নি। তখন পাশের গ্রামগুলোও নতুন বসতিতে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু অবলুপ্ত জনপদগুলো জনশ্রুতি হিসাবে রয়ে যায়।
টুটপাড়া
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন টুটপাড়া
মির্জাপুর মাঠ এলাকার পাশের গ্রাম টুটপাড়া, বেনেখামার, শেখ পাড়া, মিয়াবাগ, শিববাড়ী, বাগমারা, বানরগাতী, গোবরচাকা। মহকুমা সদরের দক্ষিণ দিকে সবচেয়ে নিকটে টুটপাড়া পুরান বসতিপূর্ণ গ্রাম। টুটপাড়া মুলত: ট্যাকপাড়া থেকে উৎপত্তি। ট্যাক নামে অনেক জায়গার নাম আছে। বিলের পাশে বা মাঝের উঁচু জায়গাকে সাধারণত ট্যাক বলে। এখানে ভৈরবতীরের দক্ষিণ দিকের বিলের পাশের উঁচু জায়গায় প্রথম বসতি গড়ে ওঠায় পার্শ্ববর্তী বসতির কাছে এ জায়গা ট্যাক নামে পরিচিত হয় এবং ট্যাকসাড়া পরে উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়ে টুটপাড়া নাম হয়। যতদূর জানা যায় প্রথম টুটপাড়া বর্তমান কবিখেলা বা গাছতলার পাশ দিয়ে এ অঞ্চলের প্রাচীন বাসিন্দা নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের কিছু লোক বসতি স্থাপন করে। নমঃশূদ্র সম্প্রদায় এখানের বর্তমান বসতির প্রাচীন অংশ এবং কবিখোলার বটগাছটি প্রাচীনত্বের স্বাক্ষর হিসাবে বহু বিপর্যয়ের পরও টিকে আছে। এই বটগাছতলায় স্থানীয় দেব-দেবীর পূজা হোত এবং পূজা শেষে কবি গানের আসর বসত। বটগাছতলায় দেবস্থান থাকায় স্থানটি গাছতলা হিসেবে পরিচিত। নমঃশূদ্রের বসতির উত্তরে ও মির্জাপুরের দক্ষিণে পরবর্তী সময়ে মুসলমানদের বসতি শুরু হধ এবং জেলা সদর স্থাপনের পর এখানে কিছু বর্ণ হিন্দুর বসতি হয়। উল্লেখ্য প্রায় সকল জন বসতিপূর্ণ গ্রাম বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে পূর্ব নামে সম্প্রসারিত বা কখনও সঙ্কুচিত হয়েছে। আবার কখনও বা তার একাংশ নতুন নামে পরিচিত হয়েছে। এ জন্যে কোন গ্রামের কোন নির্দিষ্ট সীমানা থাকেনা বা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। জেলা সদর গঠনের পর এই গ্রামের উত্তরাংশ (খান জাহান আলী রোডের উত্তর দিক) জেলা শহরের মধ্যে গন্য হয়ে যায় এবং দক্ষিণাংশ টুটপাড়া নামে পরিচিত থেকে দক্ষিণ পুবদিকে আরও সম্প্রসারিত হয়। এভাবে ক্রমাগত বসতির বিস্তার অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে পুরান টুটপাড়া গ্রামের সীমানা অনুমান করা কঠিন।
বেনেখামার
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন বেনেখামার
টুটপাড়া গ্রামের পশ্চিমে এবং মির্জাপুর মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে বেনেখামার বিস্তৃত গ্রাম। নামের শব্দার্থে গ্রামের নামকরণ পরিস্ফুট। এখানে বেনেদের খামার কোন, সময়ে এবং বিস্তৃত গ্রামের কোন অংশে খামার হয়েছিল তার সঠিক সময় ও স্থান নির্দেশ পাওয়া যায়না। তবে বেনেদের খামারের জন্যে বসতির নাম বেনেখামার হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। বেনেখামার খুব প্রাচীন গ্রাম। কয়েকটি প্রাচীন জলাশয় ও গাছ এর প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দেয়। কোন এলাকায় একসময় জনবসতি গড়ে উঠে, আবার কিছু কাল পরে নানা কারণে সে বসতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। পরিত্যক্ত বসতি চিহ্ন অল্প দিনের মধ্যে প্রাকৃতিক, আর্দ্রতা ও লবণাক্ততার জন্যে ধ্বংস প্রাপ্ত হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ জলাশয় ও বসতির পাশের প্রাচীন গাছ প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে শতশত বছর পরেও জনবসতির সাক্ষ্য হিসেবে অবস্থান করে। বেনেখামার গ্রাম মধ্যে এ রকম কয়েকটি প্রাচীন জলাশয় ও তেঁতুল গাছ গ্রামের প্রাচীনত্বের প্রতি অনুসন্ধিৎসুদের আকৃষ্ট করে। অনেকে মনে করেন বেনেখামার অপেক্ষাকৃত আধুনিক গ্রাম। পূর্বে এখানে ভিন্ন নামে কোন মুসলিম সমৃদ্ধপূর্ণ গ্রাম ছিল। মির্জাপুর নামে বসতি গড়ে ওঠার পুর্বে এই জনপদ বসতিশূন্য হয়ে পড়ে। তারপরে বেনেরা এখানে গাতি ও খামার করে এবং খামার মধ্যে বসতি স্থাপন করে বেনেখামার নামে পরিচিত হয়। জলাশয়গুলির ও গ্রামের কয়েকটি জায়গায় পরিচয় ও বসতি পর্যালোচনা করলে এই মতের পরিপুরক যুক্তি পাওয়া যায়। সহজেই অনুমেয় পূর্বের বেনেখামার ও আজকের বেনেখামার এক সীমানার আওতাভূক্ত নয়। দীর্ঘ দিন ধরেক্রমশঃ বিস্তার লাভ করে পূর্বে ও পশ্চিমে যতদূর সম্প্রসারিত হয়েছে সে অংশ বেনেখামারের আওতাভূক্ত হয়েছে। এই সম্প্রসারণের মধ্যস্থ ভিন্ন নামে ক্ষুদ্র জনপদগুলিকেও উদরসাৎ করেছে।
বেনেখামার গ্রাম অনেক আগে থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম দু’ভাগে বিভক্ত। পূর্ব এবং পশ্চিম ভাগের মধ্যে একটা প্রশস্ত খাল বর্তমান ময়লাপোতা মোড়ের দক্ষিণ- পশ্চিম দিয়ে শেরেবাংলা রোড বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত ছিল। এই খালই পুব ও পশ্চিম ভাগের বিভক্তির কারণ। প্রশস্ত এই খালটি ময়ুর নদী থেকে উঠে এসে উত্তর ও সামান্য উত্তর পুবে বেঁকে পরে সোজা বর্তমান ময়লাপোতার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং অপর একটি খাল ময়ূর নদীর শাখা চর। নদী থেকে এ কে বেঁকে বাগমারা গ্রামের মধ্য দিয়ে মাঝি পাড়ার পাশে পূর্বোক্ত খালের সাথে যুক্ত হয়। আর একটা সরু খাল দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এঁকে বেঁকে এসে ওই একই স্থানে মিলিত হয়ে একটা ত্রিমোহনীর সৃষ্টি করে তিন খালের স্রোতের চাপে এখানে একটা গোলা (ঘূর্ণিস্রোত) হয়। এই ত্রিমোহনী থেকে একটা সরু খাল উত্তর পশ্চিম মুখী হয়ে রেল ষ্টশনের অদূরে পাঁচ নম্বর ঘাটের কাছে ভৈরব নদীতে পড়ে। ময়ূর থেকে অপর একটি শাখা খাল উত্তর দিকে এসে প্রথমোক্ত খালের সাথে ঘাটকূলের অদুরে (বর্তমান গল্লামারী নতুন সড়কের পাশে আলকাতরা ফ্যাক্টরীর কাছে) মিলিত হয়ে আরও একটা ত্রিমোহনীর সৃষ্টি করে। এই ত্রিমোহনীর পাশের একটা জায়গা লোকে ঘাটকুল বলে। এ ছাড়াও ময়ূর নদীর উত্তর দিকে আরো কয়েকটা খাল প্রবাহিত ছিল। ময়ূর নদীর বিবর্তনের ফলে আলোচিত খাল তিনটি দোটানায় (দ্বি-মুখী স্রোত। পড়ে ক্রমাগত ভরাট হয়ে যায়। খুলনা পৌরসভা হবার পর মৃত খালের ডিমোহনীর (বর্তমান ময়লা-পোতা এলাকা) নীচু থাত শহরের ময়লা ফেলার স্থানরূপে নির্দিষ্ট হয় বাগমারার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত অপর খালটির নীচু স্থান ‘কান্দর’ নামে পরিচিত। এখনও বাগমারার মধ্যে কান্দরের কিছু কিছু অবশেষ রয়েছে। ডিমোহনী থেকে ভৈরব মুখী সরু খালটিও সমসময়ে একই পরিণতি ঘটে। রেল লাইন বসানর সময় ও শহর সম্প্রসারণে খালের নীচু খাত ভরাট হয়ে সম্পূর্ণ অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। বেনেখামারের মধ্যের খাল পারের বিশেষ বিশেষ স্থানের নাম আজও লোক মুখে প্রচারিত আছে। স্থানীয় প্রবীণ লোকেরা খাল পারের আধুনিক নামকরণ হওয়া স্বত্ত্বেও স্থান পরিচিতির জন্য পুরাতন নামগুলি অর্থাৎ নাজিরঘাট, মাঝি পাড়া, ঘাটকূল ইত্যাদি নাম ব্যবহার করেন।
নাজীরঘাট
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন নাজীরঘাট
নাজিরঘাট এ এলাকার বহুল প্রচলিত নাম। অনেকে নাজিরঘাটকে ঘাট- কূলও বলেন। নাজিরবাট এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সুন্দরবনের কাঠ, গোলপাতা, মধু বিক্রয়ের একটা কেন্দ্র ছিল এবং কাঠ, গোলপাতা ও মধু বোঝাই নৌকাগুলি অবস্থান করত। পূর্ব ও পশ্চিম বেনেখামারের পারাপারের খেয়াঘাট এখানেই অবস্থিত ছিল। সুন্দরবনের সাথে সম্পর্কিত ব্যবসায়ী নৌকার অনেক মাঝি শের-এ-বাংলা ও রায়পাড়া সড়কের উত্তর-পুবে বসবাস করতো। এই এলাকা মাঝিদের বসবাস হেতু মাঝিপাড়া বলে পরিচিত হয় (বর্তমান ইকবাল নগর)।
নাজিরঘাট সম্পর্কে জানা যায় যে, সময়ে বেনে খামার সহ তৎপার্শ্ববর্তী এলাকা পুনঃ জনবসতি গড়ে ওঠে তখন জনৈক নাজির এখানে সুন্দরবনের কাঠ, গোলপাতা ও মধুর ব্যবসা করতেন এবং তার কাঠ, গোলপাতা বোঝাই নৌকা- গুলো খালের এখানে বিক্রয়ার্থে অপেক্ষা করত। এ জন্যে বিক্রয় কেন্দ্রের ঘাট নাজিরঘাট বলে পরিচিত হয়। ভিন্ন মতে উক্ত নাজির ঘাটের কাছে বাস করতেন ও খেয়াঘাটের ইজারাদার ছিলেন। তিনি এখানে কাঠ, গোলপাতা, মধু বিক্রয়ের পত্তন করেন। লোকে তার নামে ঘাটকে নাজিরঘাট বলে অভিহিত করতো। পশ্চিম বেনেখামারের কবি ইউছুফ সাহেবের বাড়ীর ওখানেই নাজিরের বাড়ী ছিল বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন। বেনেখামার গ্রামের অনেক পরি – বার সুন্দরবনের ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত ছিলেন।
নাজিরঘাট থেকে বেনেখামার গ্রামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বা গল্লামারী গাঙ পর্যন্ত কয়েকটা অবলুপ্ত জনবসতির সন্ধান পাওয়া যায়। গল্লামারী এক সময়ে গ্রাম ছিল এবং এই গাঙ গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গ্রামের নামে গাঙের নাম হয় গল্লামারী গাঙ। মূলতঃ এ গাঙ ময়ূর নদীর প্রবাহ। বসতির পাশের অংশ বসতির নামে পরিচিত হয়। গল্লামারী পোল হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই এখানে একটা খেয়া ছিল। এ পথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমে গ্রামগুলোর সাথে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও যাতায়াত হোত।
গল্লামারী—গুড়িমারী ডুবি দেয়ালবাড়ী
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন গল্লামারী—গুড়িমারী ডুবি দেয়ালবাড়ী
গল্লামারী খেয়াঘাট থেকে পুবে ও পশ্চিম বেনেখামারের দক্ষিণে বর্তমান গল্পা- মারী সড়কের পাশে একটা উঁচু ভিটা ও পার্শ্ববর্তী জায়গাকে লোকে শুড়ীমারী বলে অভিহিত করে। এই ভিটা ও পাশের জমিতে প্রাচীন বসতির চিহ্ন প্রচুর পোড়ামাটির ভাঙ্গ। চাড়া দেখা যায়। শুড়ীমারীর পাশ দিয়ে প্রবাহিত খালকে শুড়ীশরীর খাল বা শুড়ীখালী বলে। শুড়ীমারী থেকে পুবদিকে ও বাগমারা থেকে পশ্চিমে বিলের মধ্যে দেয়ালবাড়ী (বর্তমান নিরালা আবাসিক এলাকা) ও তার দক্ষিণে খোলাবাড়ী এবং পাশে ডুবি নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান শতকের প্রথম দিকেও এখানে হোগলা বন ছিল। বেনেখামার গ্রামের প্রবীণেরা অনেকে বলেন যে, দেয়ালবাড়ী এলাকায় ডুবিতে (দেয়াল বাড়ীর পাশে) আগে বন্ধু মোষ ছিল। লোকে হোগলা কাটতে গেলে অনেক সময় তাড়া করতো। এ কথা তারা মুরুব্বিদের মুখে শুনেছেন এবং এ সম্পর্কে অনেক গল্পও বলেন। গল্পে কিছু অতিরঞ্জন হয়তো থাকতে পারে, তবে লোক- মুখের এ তথ্য অভিরঞ্জন বলে মনে করার কোন কারণ দেখিনে। দেয়ালবাড়ী ও খোলাবাড়ী নাম স্পষ্ট দুটে। বসতবাড়ীর আভাস পাওয়া যায়। বিশেষ ভাবে এ দুটো বাড়ীর নাম উল্লেখিত হওয়ার কারণ সম্ভবতঃ অনদুরত্বের দুটো বসতির গ্রাম প্রধান বা বিশিষ্ট ব্যক্তির বাড়ীর একটার চারপাশে দেয়াল ঘেরা ও অপরটি খোলা ছিল বলেই এভাবে পরিচিত হয়। বেনেখামারের পূর্ব বসতি, গল্লামারী, শুড়ীমারী ও তার সংলগ্ন গ্রামগুলো যে সময়ে ও যে কারণে জনশূন্য হয়ে পড়ে সেই একই কারণে এ বসতিও জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং তাদের গৃহপালিত মোষগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় বসতির আশে-পাশে থেকে বন্য হয়ে যায়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী লোকদের কাছে এ উল্লেখযোগ্য বসতির নামের স্মৃতি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। পরবর্তী মৌজা গঠনকালে খোলাবাড়ী, দেয়াল শাড়ী ও ডুবি নামে মৌজা গঠিত হয়। ডুবি, দেয়ালবাড়ী, খোলাবাড়ীর পূর্ব বসতির আরও অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। উভয় বেনেখামার ও বানরগাতীর দক্ষিণ পাশ দিয়ে বেশ কয়েকটি রাস্তা বিলের মধ্যে উল্লেখিত এলাকায় প্রসারিত ছিল। গল্লামারী নতুন সড়ক নির্মা- ণের আগে এসব রাস্ত’র অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যেত। এখনও কিছু কিছু দেখা যায়। বেনেখামার মোড়ল পুকুরের কাছ থেকে বাগমারার পশ্চিম পাশ দিয়ে একটা রাস্তা বিলের মধ্যের প্রাচীন বটগাছ এবং আলকাতরা ফ্যাক্টরীর পাশ দিয়ে একটা রাস্তা বিলের মধ্যে পর্যন্ত ছিল ও আছে। এ থেকে সহজে অনুমেয় এসব রাস্তা বেনেখামার থেকে দক্ষিণ দিকের দেয়ালবাড়ী, খোলাবাড়ী, ডুবি, বাসাবাড়ী প্রভৃতি অবলুপ্ত জনপদগুলির সংযোগ রাস্তা ছিল।
বুড়ো মৌলবী
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন বুড়ো মৌলবী
গল্লামারী থেকে অল্প দূরত্বে বুড়ো মৌলবীর দরগার কয়েক রশি দক্ষিণ পূর্বে বড়ভিটা নামে বিলের মধ্যে একটা ভিটা আছে। পূর্ব-বেনেখামারের দক্ষিণ দিকে মালোভিটা নামে একটা জায়গা চিহ্নিত হয়। এ ধরনের বেশ কয়েকটি ভিটা ময়ুর নদীর দু’পাশে ছিল এবং উক্ত এলাকায় ছোট ছোট বহু ভিটার অবস্থিতি ছিল। পরে চাষাবাদের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট ও নীচু হয়ে গেছে। আলোচিত এলাকা মধ্যে পাকা মসজিদ ও ঈদগাহের সন্ধান পাওয়া যায়। বেনেখামারের প্রবীণ লোকেরা মসজিদ ও ঈদগাহের স্থান নির্দেশ করেন। মসজিদের জায়গা উঁচু ভিটা ছিল এবং কেহ চাষাবাদ করত না। এ জমির পাশের জমি পশ্চিম বেনেখামারের জনৈক আমীর উদ্দীনের ছিল এবং তিনি এ জমি প্রথম চাষাবাদ করেন ও বর্তমানে তাদেরই আছে। ঈদগাহের সম্পর্কে জানা যায় দেয়াল বাড়ীর দক্ষিণে এ ঈদগাহ, ছিল। এলাকা সম্পূর্ণ পতিত হয়ে গেলে জমি ও গাতির মালিক বুড়ো মৌলবী সাহেব জনৈক সাৰ্থক মুচিকে ঈদগাহের পাশের কিছু জমি দান করেন। সার্থক মুচির ছেলে বসন্ত ও মনুর কাছ থেকে এ জমির সাথে ঈদগাহ অন্তর্ভুক্ত করে রাম বাড়ুজ্যে খরিদ করেন।
ডুবির পশ্চিম পাশে ও গল্লামারীর দক্ষিণে অল্পদূরে বাসাবাড়ীতে বুড়ো মৌলবী সাহেবের দরগাহ অবস্থিত। বাসাবাড়ী কোন বসতি এলাকার নাম হওয়া স্বাভাবিক। এ নামের গ্রাম খুলনায় আরও আছে। কেহ কেহ বলেন বুডো মৌলবী সাহেব নিজ বাড়ী ঘূর্ণি দেয়াপাড়া (যশোর) থেকে এখানে এসে মাঝে মাঝে বাস করে থাকতেন বলে জায়গার নাম বাসাবাড়ী হয়। বুড়ো মৌলবী সাহেব সম্পর্কে যতদুর জানা যায়, তিনি খাজনা আদায়ের জন্যে আসতেন এবং বাসাবা টাতেই (বর্তমান দরগাহ অবস্থান করতেন। বেনে খামার ও বানরগাতিতে তাঁর পাইক বরকন্দাজ থাকতো। বানরগাতীর গোপাল বরকন্দাজ ও মহেন্দ্র বরকন্দাজ বুড়ো মৌলবী সাহেবের অধীন বরকন্দাজ ছিলেন। এ সূত্রেই পরিবারের পদবী বরকন্দাজ হয়। অনুরূপ মুসলিম পরিবার দার পদবীতে পরিচিত হয়।
বুড়ে মৌলবী সাহেবের প্রকৃত নাম আবুল বাশার। তিনি জনৈক সুলতান আহমেদ (যশোর) এর কাছ থেকে দেয়ালবাড়ী-হরিনটানা-ডুবি-আলুতলা-কেষ্টনগর-জিনারআবাদ মৌজাগুলি প্রাপ্ত হন এবং অতিশয় বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এখানে যাতায়াত করতেন। বৃদ্ধবয়স ও ধর্মপরায়ণতার জন্যে লোকে শ্রদ্ধা ভরে বুড়া মৗলবী বলে অভিহিত করতেন। মৗলবী সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল অনুরাগীগণ বাসাবাড়ীর আস্তানা স্মরণীয় করে রাখেন এবং মৌজাগুলি বরদাকান্ত রায়ের অধীন চলে যায়। বুড়ো মৌলবী সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান মগ ফিরিঙ্গী দস্যুদের কঠোরভাবে দমন করার আগে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম এলাকা বাকলা (চন্দ্রদ্বীপ) সলিমাবাদ (পিরোজপুর) যশোর (যশোর রাজ্য বর্তমান খুলনা ও যশোর জেলার অধিকাংশ) হিজলী (চব্বিশপরগণা) প্রভৃতি জায়গা তাদের অবাধ লুণ্ঠন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। পর্তুগীজ মিশনারী পাদ্রী ম্যানরিক সাহেবের বিবরণ থেকে জানা যায় ফিরিঙ্গী দস্যুদের যশোরের প্রতি ঝোঁক ছিল অধিক। বাংলা থেকে দস্যুগণ বিতাড়িত হবার বহুকাল পর পর্যন্ত সুন্দরবনে আত্মগোপনকারী দস্যুগণ নিকটবর্তী ___ নদীপথের জনপদগুলির উপর অত্যাচার অব্যাহত রেখেছিল। এ থেকে অনুমান করা যায় সুন্দরবন থেকে পশর নদী হয়ে ময়ূর নদীতে প্রবেশের সহজ ময়ুর নদী মাথাভাঙ্গার কাছে কাজিবাছায় পতিত হয় এবং পশরের এ অংশের নাম কাজিবাছা পথ থাকায় এবং ময়ুর থেকে উত্তরে ভৈরবের অল্প দূরত্বের কারণে উভয় দিক দিয়ে জলদস্যুদের আক্রমণে ময়ুর নদীর তীর ধরে ভৈরবের তীর পর্যন্ত অভ্যন্তর ভাগের জনবসতি বিপর্যস্ত হয়েছিল। পরে অবস্থা পরিবর্তিত হলে ময়ুর নদীর উত্তরে ও ভৈরব তীরের মধ্যবর্তী অংশে পুনঃবসতি সংগঠিত হলেও ময়ুর নদীর দু পাশে আর কোন বসতি গড়ে ওঠেনি।
আন্ধি পুকুর
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন আন্ধি পুকুর
পূর্ব ও পশ্চিম বেনেখামারে আন্ধিপুকুর নামে দুটি প্রাচীন দীঘি বা জলাশয় আছে। আন্ধি পুকুরের খননকাল আজও ঐতিহাসিকভাবে নির্ণীত হয়নি। খলিফাতাবাদ (বাগেরহাট) থেকে বারবাজার পর্যন্ত ভৈরবতীর ধরে অনেক গুলো আন্ধিপুকুর নামে প্রাচীন বৃহৎ জলাশয় দেখা যায়। অনেকে আন্ধিপুকুরকে খানজাহান আলীর কীর্তিসমুহের অন্যতম বলে মনে করেন। যশোর-খুলনা মুসলিম কীর্তিসমূহ ঐতিহাসিক তথ্যের সরলীকরণ করে এতদাঞ্চলীয় মুসলিম বসতির ধারাবাহিক বিকাশের সংক্ষিপ্তকরণের প্রয়াশে অনস্বীকার্য খানজাহান এর কীর্তিসমূহের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে। যশোর-খুলনার আঞ্চলিক ইতিহাস প্রণেতাগণ আন্ধিকে অন্ধকার (আঁধার) পুকুর আখ্যায়িত করে ব্যাখ্যায় বলেছেন যে জলাশয়ের গভীরতা ও পাড়ের গাছ পালায় আচ্ছাদিত থাকায় লোকে অন্ধকার পুকুর বলত। অন্ধকার ক্রমে রূপ নিয়েছে আন্ধিতে। অন্য অর্থে আন্ধিকে ফার্সী শব্দার্থে অন্ধকার অর্থ করে আধিপুকুর বলেছেন। কিন্তু যদি একটা বা দুটা অনুরূপ পুকুরের অবস্থান থাকতে। তবে উক্ত অর্থ সরল মনে গ্রহণ করায় কোন দ্বিধা থাকতো না। খলিফাতাবাদ থেকে বারবাজার পর্যন্ত মুসলিম প্রাধান্যপূর্ণ গ্রামগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আন্ধিপুকুরের অবস্থান থাকায় ও সর্বত্র একই নামে অভিহিত হওয়ায় উক্ত ব্যাখ্যা গ্রহণে দ্বিধা আসে। বোধগম্য কারণে ভৈরবতীরের অবলুপ্ত প্রাচীন কীর্তি সমূহের অবশেষ ইতিহাসের আলোকে নিয়ে আসার ঐকান্তিকতার অভাবে পূর্ববর্তীদের সরলীকরণে আবর্তিত হয়েছে। যে কারণে অনুমানের উপর নির্ভর করা ছাড়া প্রামাণ্য কোন পরিচয় তথ্যের অভাবে দেয়া সম্ভব নয়।
শব্দার্থেই যদি নামের ভিত্তি ধরা হয় তবে তুর্ক-আফগান আমলের পূর্বে এ অঞ্চলে ফার্সীভাষা বা শব্দের আগমন ঘটেনি। বঙ্গে মুসলিম বিজয়ের পর ভৈরব- তীর ধরে ক্রমাগত মুসলিম বসতি স্থাপন কালে এ জলাশয়গুলি খনিত হয়েছিল। এতদাঞ্চলে খানজাহানের রাস্তা দীঘি খননের ব্যাপকত। সর্বজন স্বীকৃত এবং খানজাহান কর্তৃক খনত দীঘি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। কিন্তু একই নামে দীর্ঘ এলাকায় অনেকগুলো পুকুর তার কীর্তি বলে অনুমিত হয় না। এছাড়াও খানজাহান খনিত কোন জলাশয় পুকুর বলে অভিহিত নয়। সম্ভবতঃ এ অঞ্চলে মুসলিম বসতি বিস্তার লাভ করলে পানীয় জলের অভাব নিবারণের জন্যে খান-জাহানের পূর্বে কোন আঞ্চলিক শাসনকর্তা নিজ নামে বা গভীরভাবে খনিত জলাশয়গুলোর অনুরূপ নামকরণ করেন।
পশ্চিম বেনেখামারের আন্ধিপুকুরটি স্বনামে সাধারণ ব্যবহার্য পুকুর হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে ধাপদামে পূর্ণ অব্যবহৃত পুকুরকে অপেক্ষাকৃত ছোট করে পুনঃখনন ও ব্যবহার উপযোগী করা হয়। জেলা বোর্ড বা ব্যক্তিগতভাবে আন্ধি পুকুরগুলো পুনঃখননকালে অধিকাংশ পুকুর থেকে পাকা ঘাটের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অপর আন্ধি পুকুরটি পূর্ব বেনেখামারের মৌলবী পাড়া ও দোলখোলার মধ্যবর্তী জায়গায় বর্তমান দোলখোলা রোডে অবস্থিত ছিল। এ পুকুরটিও অন্যান্য প্রাচীন জলাশয়ের মতো ধাপদামে পূর্ণ হয়ে অব্যবহার্য হয়ে পড়ে ও কালান্তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। পুকুরটির উত্তর দিকের একাংশ সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী ও দক্ষিণাংশ ভরাট করা হয়। বিভাগোত্তর কালে উত্তর পাড়ের জমিসহ ব্যবহৃত পুকুর ও বিভিন্ন সময় পুব ও পশ্চিম পাড়ের জমি বিভিন্ন লোকের কাছে বিক্রীত হয়। এ শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে পুকুর সহ উত্তর পাড়ের ক্রেতা পুকুরের অগভীরতা, জোব ও পেড়ীর জন্যে পুনঃ খননের উদ্যোগ নেন কিন্তু সামান্য কাটার পর সম্পূর্ণ জোবমাটি উঠতে থাকে এবং পাড়গুলোতে ফাটল দেখা দেয়। পাড়ের ফাটলে বাড়ী ঘর ভেঙ্গে পড়া আশংকায় পুকুরের মালিক সহ পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। সাথে সাথে নানা উপকথা ও কিংবদন্তি ছাড়াতে থাকে। ফলে পার্শ্ববর্তী ও শহরের অনেকে উপকথায় আকৃষ্ট হয়ে ঘটনা দেখতে ভীড় জমায়। ভয়ে অনেক খনন শ্রমিক পালিয়ে যায় এবং পুকুরের খনন কাজ পরিত্যক্ত হয়। দর্শনার্থী কেহ কেহ উৎসুক্য বশতঃ পুকুর থেকে ওঠা জোবমাটি নিয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী অনেকে এ জোব জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে। অনুরূপ জোব মাটি জ্বালানীর ব্যবহার দেখা গেছে শিব বাড়ীর দক্ষিণে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নির্মাণে ভূমি ভরাট করার জন্যে পাশে বিলে মাটি কাটার সময় কয়েক হাত নীচে জোবের স্তর থেকে জোবমাটি তুলে রাস্তার পাশে শুকিয়ে জ্বালানী করতে।
আরও একটা প্রাচীন জলাশয় আলোচিত আন্ধি পুকুরের পূবে ও মৌলবী পাড়ার দক্ষিণে জনৈক পৌর কর্মচারীর বাড়ীর সীমনার মধ্যে বড় পুকুর নামে পরিচিত। এই পুকুরটর খনন কাল জানা যায় না, তবে উক্ত কর্মচারীর মতে পুরুষামুক্রমে বড় পুকুর নামে অভিহিত হয়ে আসছে। ঘাটের দশকের শেষের দিকে পুকুরটি সংস্কার ও পুনঃখনন করা হয়। কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চার পাড় দিয়ে লোক নেমে পাড় ভেঙ্গে কয়েক বছরের মধ্যে অস্তিম অবস্থায় পৌঁছেছে। আরও একটি প্রাচীন জলাশয় মাঝিপাড়ার মধ্যে অবস্থিত ছিল। বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে ডুমুরিয়ার ভট্টচার্যিরা পুকুর সহ পার্শ্ববর্তী জমি ক্রয় করে পুকুরের একাংশ পুনঃখনন করে বাকী অংশ ভরাট করে ফেলেন। উভয় বেনেখামার মধ্যে কয়েক শ’ বছর বয়সের কয়েকটা তেঁতুল গাছ রয়েছে। সাধারণত তেঁতুল গাছ দীর্ঘজীবী হয় ও লোকালয়ে জন্মায়। প্রাচীন গাছগুলোর বয়সের অনুমানে বসতির প্রাচীনত্ব অনুমানে সহায়ক হয়। লক্ষণীয় বিস্ততে বেনেখামার গ্রাম মধ্যে কোন প্রাচীন মন্দির বা দেবালয়ের অবস্থিতি নেই। দোলখোলা (দোলবেদী) ও শীতলা বাড়ী (শীতলা মন্দির) রায় পাড়ার রায় উপাধিযুক্ত ব্রাহ্মণ হীরালাল রায়ের প্রতিষ্ঠিত। এ সব কারণে ও পরবর্তী বেনেখামারের বসতির পর্যালোচনা করলে পূর্বেও এখানে মুসলিম বসতিপূর্ণ গ্রাম ছিল বলে অনুমিত হয়।
মসজিদ
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন মসজিদ
পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, বেনে খামারের পূর্ব-বসতির কয়েকটি প্রাচীন জলাশয় ভিন্ন মানুষের রচিত কোন চিহ্ন বিভিন্ন ভাবে বিলুপ্ত হয়েছে এবং পরবর্তী বসতি পশ্চিম দিকে অর্থাৎ পশ্চিম বেনেখামারে বিস্তার লাভ করে ক্রমাগত পূর্বদিকে সরে এসেছে। এ এলাকার সবচেয়ে পুরান মসজিদ পশ্চিম বেনেয়ামারের মাদ্রাসার উত্তর পাশে মোড়ল বাড়ীর সীমানা মধ্যের মসজিদ। সম্ভবত এই এলাকায় নতুন করে মুসলিম বসতি গড়ে ওঠার সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ পর্যন্ত মসজিদটি কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে বলে জানা যায়।
বেনেখামার পূর্বপাড়া মসজিদটিও অনেক পুরান এবং এ এলাকায় বসতি গড়ে ওঠার সমসাময়িক বলে মনে হয়। মসজিদটি প্রথমে কোথায় স্থাপিত হয়েছিল ঠিক জানা যায়না, তবে ১৯১১ সালে পাকা মসজিদ নির্মাণের আগে দীর্ঘ দিন উত্তর পশ্চিম-দিকের ওনৈক মুজাই গাজীদের বাড়ীর সীমানার মধ্যে ছিল। এই বংশের জনাব মহম্মদ আলির নিকট রক্ষিত ১৮৯_ সালের এক বাটোয়ারা দলিলে দেখা যায় সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় মসজিদ মুজাই গাজীর অংশে পড়ে। এরও আগে মসজিদ পশ্চিম দিকে জনৈক আদিল সেখ ও সাদেক সেখদের বাড়ীতে ছিল।
১৯১৯ সালে স্থায়ী পাকা মসজিদ নির্মাণের জন্য জমি দান করেন মনিক মোড়ল ও ছমির মোড়ল। জনৈক সাদেক শেখ (মিস্ত্রি) এর উদ্যোগে মানিক মোড়ল, ছমির মোড়ল, বাদুল্যা শেখ, মুন্সি ধোনাই শেখ প্রমুখ স্থানীয়দের সহযোগিতায় মসজিদ পাকা করা হয়।
পূর্ব ও পশ্চিম বেনেখামারের মসজিদ দুটির অধিক দূরত্বের জন্য মুসল্লীদের যাতায়াত বিশেষকরে বর্ষাকালের অসুবিধার জন্য বর্তমান হাজী বাড়ীর এলাকার মধ্যে মসজিদটি স্থানীয়দের উদ্যোগে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে নির্মিত হয়। মসজিদটির গঠন প্রকৃতি সুন্দর। অপর মসজিদটি পশ্চিম বেনেখামারের উত্তর দিকে (বসু পাড়া) ১৯২১/২২ সালে অনুরূপ প্রয়োজনে জনাব মোজাম শেখ নিজ বাড়ীর সামনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদটি বসুপাড়া মসজিদ নামে খ্যাত।
শিতলাবাড়ী
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন শিতলাবাড়ী
বেনেখামারের একমাত্র মন্দির পূর্ব-বেনেখামারের শীতলা বাড়ী আনুষ্ঠানিক ভাবে নির্মিত নয় বলে জানা যায়। ১৮৯৫/৯৬ সালের দিকে পূর্ব বেনেখামারের জনৈক তিন কড়ি শেখের ভিটা জমিতে (শীতলা বাড়ীর জায়গা) একটা প্রাচীন বট গাছের গোড়ায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ইট ও গাছ-গাছড়া পরিষ্কার করার সময় একখানা ছোট প্রতিমা দেখতে পান (মতান্তরে স্বপ্নপ্রাপ্ত)। বটগাছের কাছে এক ঝাড় কাঁটা সেজার গাছ ছিল (মতান্তরে সেজি গাছের গোড়ায় শীতলা প্রতিমা পাওয়া যায়)। তিনকড়ি শেখ প্রতিমা প্রাপ্তির কথা নিকটের ব্রাহ্মণ গতিদার বাবু হীরালাল রায় (মুখার্জী) কে জানান এবং তারই তত্ত্বাবধানে উক্ত বটমূলে প্রতিমা পূজার ব্যবস্থা হয়। তিনি তিনকড়ি শেখের কাছ থেকে জমিটা শীলতা বাড়ীর জন্যে নিয়ে নেন। তিন কড়ি শেখ সরল ও বোকা প্রকৃতির জন্যে গ্রামের লোক তাকে তেড়ে বলদে বলে ডাকতো। তিনকড়ি শেখ ও শীতলা বাড়ীকে কেন্দ্র করে অনেক গল্পকথা লোকমুখে শোনা যায়।
এ ভাবে কিছুদিন পূজা হওয়ার পর বটগাছের পাশে ছোট খড়ের ঘর তুলে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯২১/২২ সালের দিকে শীতলা বাড়ীর পাশের জমি খরিদ করে পুকুর কাটা ও পাকা মন্দির নির্মাণ করা হয়। হীরালাল বাবুর মৃত্যুর পর (বাংলা ১৩০৫) মাড়োয়াড়ীগণ উৎসাহী হয়ে শীতলা বাড়ীর অনেক উন্নতি করেন। শোনা যায়, প্রাপ্ত প্রতিমাটি এখন নেই। বর্তমান শীতলাবাড়ীতে অবস্থানরত হীরালাল বাবুর কন্যা বীনা রায় অনুরূপ মত প্রকাশ করেন।
প্রাচীন বটমুলে মুর্তির অবস্থিতি ও প্রাপ্তি সম্পর্কে অনুমিত হয় পূর্বে বেনেখামারের বেনেরা এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বেনেরা হয়তো কোন কারণে বিপর্যস্ত হয়ে স্থান ত্যাগ করেন। ফলে প্রতিমা অজ্ঞাত হয়ে যায়। অবস্থার পরিবর্তন হলে উঠে যাওয়া পরিবারগুলোর অধস্তনেরা ফিরে এসে শীতল। বাড়ীর উত্তর-পুবদিকে পুনঃবসতি করেন এবং তাদের নতুন বসতি বেনেপাড়া নামে পরিচিত হয়। সমসময়ের আগেই বেনেখামার মুসলিম বসতি বিস্তার লাভ করে।
মাঝিপাড়া
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন মাঝিপাড়া
রায়পাড়া সড়ক ও শেরে-বাংলা সড়কের উত্তর-পুর্ব দিকে ও ফরাজী পাড়ার দক্ষিণে বর্তমান ইকবাল নগর এলাকা পূর্ব মাঝিপাড়া নামে পরিচিত ছিল। মাঝিপাড়া তৎকালে বেনেখামার গ্রামের উত্তরাংশ ছিল। পরে মাঝি পাড়ার উত্তরে ফরাজীদের বসতি হওয়ায় বেনেখামার আরো উত্তরে সরে আসে। এখানে মাঝিদের বসতির জন্যে মাঝিপাড়া নামকরণ হয়েছে। কিন্তু এই মাঝিদের নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ রয়েছে। কারও মতে নদীর ঘাটে সুন্দরবনের কাঠ, গোল পাতা ও মধুর ব্যবসা কেন্দ্র ছিল এবং বেনেখামারের অনেকে এই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল ও তাদের ব্যবসায়ী নৌকার মাঝিরা গ্রামের এ অংশে বসবাস করতো বলে এখানের নাম হয় মাঝিপাড়া। বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে জেলা শহরের নবাগতদের কাছে মাঝিপাড়ার অধিকাংশ জমি বিক্রীত হয়ে অধিবাসীরা বেনেখামার গ্রাম মধ্যে সরে যায় এবং মাঝিপাড়া নামের অবলুপ্তি ঘটে। মাঝিপাড়ার মাঝি উপাধিযুক্ত বর্তমান জীবিতদের মধ্যে দু’একজন বেশ দুরবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছে। বেনেখামার গ্রামমধ্যে মাঝিপাড়ার উত্তরে ফরাজীদের বসতি তুলনামূলক পরে হলেও ফারাজী পাড়া মূলত ভিন্ন কোন গ্রাম নয়। ফরাজীদের একত্রে বসবাসের জন্যে গ্রামের এ অংশ ফারাজীপাড়া নামকরণ হয়।
শেখপাড়া
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন শেখপাড়া
ফারাজী পাড়ার পশ্চিমে মুসলিম প্রাধাণ্যপূর্ণ গ্রাম শেখ পাড়া। শেখ পাড়ার শেখের। এখানের পুরাতন অধিবাসী এবং তাদের বসতি আধিক্য হেতু নাম হয় শেখপাড়।। শেখ পাড়া গ্রামের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেন যে, শেখপাড়া বিস্তীর্ণ শিববাড়ী গ্রামের একাংশ এবং শেখেরা এ অংশে বসতি করায় শেখপাড়া নামে পরিচিত হয়। পাড়াযুক্ত গ্রামের নামের জন্যে এ ধারণা অমূলক নাও হতে পারে, তবে শেখপাড়া অনেক আগে থেকে স্বতন্ত্র গ্রাম। ষাটের দশকের শেষের দিকে যশোর সড়ক থেকে শেখপাড়া প্রধান সড়কের প্রবেশ পথের ডান পাশের পুকুর পাড়ে (পুকুরটি এখন ভরাট করে একটা সিনেমা ঘর করা হয়েছে) রাস্তার পাশে একটা গর্ত খোড়ার সময় মানুষের কিছু হাড় পাওয়া যায়। এ ঘটনার কিছুদিন আগে এই গর্তের কাছেই টেলিফোন পোষ্ট পোতার সময়ও মানুষের কয়েকখানা হাড় পাওয়া যায়। হাড়দৃষ্টে গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ লোক এ জায়গা একটা পুরাতন গোরস্থান বলে অভিমত প্রকাশ করেন এবং গোরস্থানের অনেকখানি যশোর রোড প্রশস্ত করার সময় রাস্তার নীচে চলে যায়। এ থেকে অনুমিত হয় রেললাইন বসানোর সময় শেখপাড়ার উত্তরাংশ রেল কর্তৃক অধিগ্রহণ কালে উচ্ছেদকৃত কোন পরিবারের পারিবারিক গোরস্থান। শেখপাড়ার পশ্চিম সীমার মাঝামাঝি পুরানো মসজিদটি এ গ্রামের প্রথম মসজিদ। শেখপাড়া মুসলিম বসতি গড়ে ওঠার সময় এ মসজিদ নির্মিত হয়ে ছিল। মসজিদের পাশ দিয়ে গোররচাকা গ্রামের সাথে কয়েকটি রাস্তার সংযোগ শেখপাড়া গোবরচাকার ঘনিষ্ট যোগাযোগের আভাস দেয় এবং গোবরচাকা গ্রামের পূর্বাংশের লোক এই মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। মসজিদের দক্ষিণ পাশের জলাশয় ও তার পাড়ের প্রাচীন একটা তেঁতুল গাছ মসজিদের প্রাচীনত্বে অনুকূল পরিচয় বহন করে। এলাকার প্রবীণেরা প্রায় সকলে একমত যে কয়েক পুরুষ আগে মসজিদটি গ্রামবাসীদের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল এবং কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে।
বাগমারা
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন বাগমারা
বেনেখামারের দক্ষিণ পাশে বাগমারা গ্রাম। খুলনায় অনেকগুলো বাগমারা গ্রাম আছে। সমুদ্র নিকটবর্তী হওয়ায় উত্তরা পলি নিঃস্মৃত শ্রোতাবর্তে নদীর ঘন ঘন গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় বাক মরে চর ভূমির সৃষ্টি হয়। নতুন জেগে ওঠা উর্বরা চরে বসতি গড়ে ওঠে বাক মরা অপভ্রংশে বাগমারা নাম হয়। বাগমারা থেকে অল্প দূরত্বে রূপসা খেয়া ঘাটের পূর্বপাশে অনুরূপ বাগমারা নামে আরও একটা গ্রাম আছে। বাগমারা গ্রামের তিন পাশ দিয়ে কয়েকটা নদী বা গাঙ (অপ্রশস্ত নদীকে গাঙ বলে) এমন ভাবে জড়াজড়ি হয়ে আছে যে পূর্বে কোন নদীর গতিপথ কি ভাবে ছিল তা ঠিক নদীর পরিবর্তিত গতিপথের মরাবাঁকে গ্রাম গড়ে বোঝা যায় না এবং কোন উঠেছিল তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে বাগমারা যে মরা বাঁক থেকে উৎপত্তি এতে কোন সন্দেহ নেই। পূর্বে আলোচিত যে খাল চরার নদী থেকে উঠে এসে উত্তরমুখী হয়ে বায়ে ঘুরে বাগমারা গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ছিল ও পরে সরে গিয়ে যে খাত বা কান্দর সৃষ্টি হয় এই খাস ও বাগমারা গ্রামকে উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ায় বিভক্ত করে। উভয় পাড়ার মধ্যে কোথাও কোথাও মরা খালের খাত বা কান্দরের চিহ্ন এখনও দেখা যায়। বাগমারা নমঃশূদ্র সম্পদায়ের বসতিপূর্ণ প্রাচীন গ্রাম গ্রামের প্রাচীন বসতির সাক্ষী হিসাবে দক্ষিণ পাড়ায় পূজা খোলার কয়েকশ বছর বয়সের বটগাছতলায় পূজাবোল। ও উত্তর পাড়ার একট তেঁতুল গাছ অতীতের স্মৃতি নিয়ে অপেক্ষা করছে। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ গ্রামে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কারো বসতি ছিলনা।
বানরগাতি
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন বানরগাতি
বেনেখামার গ্রামের পশ্চিম পাশে বানরগাতি গ্রাম। বানরগাতীর প্রকৃত নাম বেনেরগাতী বা বেনেগাতী। অপভ্রংশে বানরগাতী হয়েছে। বেনেদের গাতি মধ্যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় এসে বসবাস করায় গাতির পরিচয় বসতির পরিচয়ে হয়েছে বলে মনে হয়। খুলনায় বেনে সম্পর্কযুক্ত বেশ কয়েকটা গ্রাম বেনেখালী-বেনে পোতা ইত্যাদি পাওয়া যায়। বানরগাতী নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের বসতিপূর্ণ প্রাচীন গ্রাম। গ্রামের পশ্চিম দিকে বিলের পাশে কয়েক ঘর মুচির বাস। জেলা শহর প্রতিষ্ঠার পর মিজাপুর মাঠের অনেক মুক্তি রাস্তার পাশে জমি বিক্রী করে এখানে উঠে এসে বসতি করে এবং তখন থেকে বানরগাতীর এ অংশের নাম হয় মুচিপাড়া। নমঃশূদ্র প্রধান বাগমারা গ্রামের তুলনামূলকভাবে বানরগাতীর বিস্তৃতি বেশী। বানরগাতী গ্রামের প্রাচীনত্ব অনুমান করা যায় গ্রামের পুজোখোলা বা গাছতলার কয়েকশ বছর বয়সের বটগাছের অবস্থানে। মূল গাছের ঝুরি থেকে বিস্তার লাভ করে অনেকখানিক জায়গা ছায়াছন্ন করে রেখেছে। এই বটগাছের গোড়ায় পাকা কোন মন্দির ছিল বলে অনুমিত হয়। বটগাছের দক্ষিণ পাশের জলাশয়টিও প্রাচীন ও সমসাময়িক।
মিয়াবাগ
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন মিয়াবাগ
চার্লিগঞ্জের পশ্চিম দিকে ও ভৈরবতীর থেকে দক্ষিণে শেখপাড়ার উত্তর সীমা পর্যন্ত কিছু সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের বসতি মিয়াবাগ নামে পরিচিত ছিল (জনৈক মহম্মদ ফয়েজ উল্লাহ এখানে প্রথম বাসস্থান করে মিয়াবাগ নাম রাখেন)। মিয়াবাগে সম্ভবতঃ চার্লিগঞ্জের সমসময়ে বা তার কিছু আগে মুর্শিদাবাদ ও যশোরের খড়কি থেকে আরও কয়েকটি মুসলিম পরিবার এসে বসতি করেন এবং যতদূর জানা যায় মুর্শিদাবাদ থেকে আসা কোন কোন পরিবার স্বাস্থ্যহানির কারণে মুর্শিদাবাদ ফিরে যান ও বাকীরা মিয়াবাগে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মিয়াবাগে মিয়াদের (সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের মিয়া বলে অভিহিত করা হোত) বসতি স্থাপন সময়ে এ জায়গা ফাঁকা ও মির্জা লালমুহম্মদ-এর জায়গীরভুক্ত তার ওয়ারেশদের অধীন ছিল। মিয়াবাগ বিস্তীর্ণ প্রাচীন শিববাড়ী গ্রামের উত্তর পূর্ব অংশ ও মিয়াদের নির্ধারিত নাম মিয়াবাগ বলে পরিচিত।
শিববাড়ী
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন শিববাড়ী
মিয়াবাগ শেখপাড়ার পশ্চিমে এবং বয়রা ও খালিশপুরের পুবে উত্তর দক্ষিণ লম্বা বিস্তীর্ণ গ্রাম শিববাড়ী। শিববাড়ী গ্রাম অনেক প্রাচীন ও এখানে অবস্থিত শিবমন্দির থেকে গ্রামের নাম শিববাড়ী হয়েছে। শিববাড়ী গ্রামের কেন্দ্রস্থলে ও উত্তর দিকে নদীর পাড়ে ছ’টি শিবমন্দির আছে। কেন্দ্র স্থলের মন্দির (বর্তমান শিববাড়ীর মোড়ের কাছে) কোন সময়ে ও কার দ্বারা নির্মিত হয় জানা যায় না। এই মন্দিরটি বহু আগে ভগ্ন ও জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় তিন রাস্তার মাঝে স্বল্প পরিসরে প্রায় পরিত্যক্ত ছিল। পুর্বে হয়তো এখানে শিব চতুর্দ শীতে জাকজমকপূর্ণ পূজো ও মেলা হোত, কিন্তু গত শতকের শেষের দিকে মন্দিরের পূর্বোক্ত অবস্থার কথা জানা যায়। স্থানীয় কিছু লোক বছরে একবার শিব চতুর্দশীর দিন মন্দিরের সামনের দিকে পরিষ্কার করে পূজা দিতেন। জনশূন্য গ্রামে দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে ঘন্দিরের গায়ে গাছ গাছড়। জন্মে ধ্বংস প্রাক্তিই প্রধান কারণ বলে মনে হয়। বর্তমান শতকের মাঝামাঝি সময়ে মন্দিরটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত ও ভাঙ্গা মন্দিরের বিক্ষিপ্ত ইট বিভিন্নভাবে অপসারিত এবং সাম্প্রতিক শহর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ভগ্নস্তুপের অবশিষ্ট অপসারিত হয়ে শুধু মন্দির নামে জায়গার পরিচয় বহন করছে।
অপর মন্দিরটি আলোচিত মন্দিরের আধমাইল দূরত্বে মিয়াবাগের উত্তরে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। এই মন্দির সম্পর্কে যতদূর জানা যায় বর্তমান মন্দিরের জায়গা ও তার দক্ষিণ পাশের বৃহৎ জলাশয় মিয়াবাগের মিয়াদের অধীন ছিল। এর পশ্চিম পাশ দিয়ে পাল, কুণ্ড, কর্মকার, বারুজীবীদের বাস ছিল। নিকটবর্তী অন্য কোন বড় পুকুর না থাকায় গ্রামবাসী একমাত্র এ পুকুরের পানি ব্যবহার করতেন। একদিন পালদের এক মহিলা পানি নেওয়ার সময় পুকুরের উত্তর পাড়ে পানির কাছে লতাগুল্মের মধ্যে একখানা গোলাকৃতি পাথরের সন্ধান পান। উৎসুক্য বশতঃ পাথরখানা নাড়াচাড়া করতে গেলে গড়ায়ে অথবা পায়ের চাপে পুকুরের মধ্যে পড়ে যায়। কথাটা জানাজানি হয়ে গেলে বহু লোক ঘটনাস্থলে জমা হয় ও পুকুর থেকে পাথরখানা তুলে দেখা যায় একখানা শিবলিঙ্গ। লোক মুখে মূর্তি প্রাপ্তির কথ। চাঁচড়ার (যশোর) জমিদারের কাছে পৌঁছে। সম্ভবত শিবভক্ত চাঁচড়ার রাজারা পুকুরের উত্তর পাড়ে মন্দির নির্মাণ ও মুর্তি পুজার ব্যবস্থা করে দেন। কথিত ভাষ্যে একখানা মূর্তি প্রাপ্তিতে একটা মন্দির নির্মাণ বোঝা যায়, কিন্তু এখানের মন্দির যুগল মন্দির। মন্দিরের অবস্থান ও গঠনশৈলী দেখলে বুঝা যায় মন্দির দুটি একই সময়ে ও একই স্থপতি দ্বারা নির্মিত। প্রাপ্ত প্রতিম। ভিন্ন অপর প্রতিম। সম্পর্কে নানা মত প্রচলিত আছে কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
ভিন্ন মতে বর্তমান মন্দিরের জায়গায় পূর্বে জোড়া মন্দিরের ভগ্নাবশেষ জঙ্গলাবৃত ছিল এবং মন্দির সংলগ্ন দীঘিটি পূর্বে মন্দির দীঘি ছিল। এই জোড়ামন্দির সম্পর্কে অনেক কিংবদস্তি আছে। মগ-ফিরিঙ্গী দস্যুদের আক্রমণে শিববাড়ি গ্রামের বসতি অন্য সরে যায় ও মন্দির পরিত্যক্ত হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এলাকা পরিত্যাগ কালে পূজারীরা মন্দিরের প্রতিমা পুকুরে লুকায়ে রেখে যান। পরবর্তী সময়ে পরিত্যক্ত এই শিববাড়ি গ্রামের উত্তর পূর্বদিকে মিয়াদের বসতি ও পশ্চিম দিকে ক্রমে পাল, কুণ্ডু ও বারুজীবীদের বসতি গড়ে ওঠে কিন্তু তারা কেউ মন্দির সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। পরে আকস্মিকভাবে প্রতিমা পাওয়া গেলে চাঁচড়ার রাজারা পরিত্যক্ত মন্দিরের জঙ্গলাবৃত ভগ্নস্তূপ পরিষ্কার করে পূর্বমন্দিরের ভিতে নতুন ভাবে মন্দির নির্মাণ করে প্রাপ্ত প্রতিমাসহ অপর প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে দেন।
শেষোক্ত মত পূর্বোক্ত মতের পরিপুরক ও অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় এবং জনশ্রুতি ভিন্ন কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে একই গ্রামে দুটো মন্দিরের অবস্থান দৃষ্টে বুঝা যায় এখানে পূর্বে বর্ণ হিন্দু সমৃদ্ধ বসতি ছিল। রেললাইন বসানোর সময় শিববাড়ি গ্রামের বৃহদাংশ ও মিয়াবাগ হুকুম দখলীকৃত হয়ে মন্দির রেল এলাকাভুক্ত হয়। দীর্ঘ দিনের সংস্কারের অভাবে মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হলে বর্তমান শতকের ত্রিশের দশকে শহরের কিছু ধনীব্যক্তি ও ব্যবসায়ী মেরামত ও নতুন অঙ্গ সৌষ্ঠবে গড়ে তোলেন। এখানে প্রতি বছর শিব চতুর্দশীর দিন জাঁকজমক সহকারে পূজো ও মেলা হত। শোনা যায় রেল কোম্পানী ব্যবসায়ীক স্বার্থে ঐদিন বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা ও ব্যাপক প্রচার দিতেন।
গোবরচাকা
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন গোবরচাকা
শিববাড়ি গ্রামের দক্ষিণে ও শেখ পাড়ার পশ্চিমে গোবরচাকা মুসলিম প্রধান গ্রাম গোবরচাকা নামটা বিভ্রান্তমূলক ও গ্রামের নাম নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ রয়েছে এবং বর্তমান নাম মূল নামের অপভ্রংশ। প্রত্যেক গ্রামের নামের কোন না কোন অর্থ বা অর্থবহ ইঙ্গিত থাকে। গোবরচাকা এরকম কোন অর্থ বহন করে না। অনেকে মনে করেন, পরিত্যক্ত শিববাড়ি গ্রামের দক্ষিণাংশে বিলের পাশে পুনরায় নতুন বসতি গড়ে ওঠার সময় জনৈক গওহর এলাকা বন্দোবস্ত নিয়ে কিছু অনুসারীসহ বসবাস শুরু করেন। তদবধি এ বসতি গওহর চক নামে পরিচিত। এ যুক্তি প্রামান্য তথ্যের অভাবে অনুমান ভিত্তিক মনে হলেও বসতির বিশ্লেষণ পাশের বিল খালের নাম ও নিম্নবর্ণিত ঘটনায় অনুকুল যৌক্তিকতা অনুভূত হয়।
গোবরচাকার ঐতিহ্যবাহী হাজীবাড়ীর ইসমাইল হাজী সাহেবের প্রপিতামহ ফুলতলার বারাকপুর থেকে এখানে এসে বসতি করেন। ইসমাইল হাজী সাহেবের পিতামহ বর্তমান হাজীবাড়ীর বড় পুকুর সংস্কার কালে পুকুর মধ্যে কিছু পুজোর সরঞ্জাম (কুষা—কুষি ইত্যাদি) পেয়েছিলেন এবং পুকুর পাড়ে বাগান মধ্যে একটা উঁচু জায়গাকে আজও দোলবেদী বলে কথিত হয়। এ তথ্যে পূর্বে এখানে কোন ব্রাহ্মণের বাড়ী ছিল এবং পরিত্যাগকালে এগুলো পুকুর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয় বলে অনুমিত হয়। উল্লেখ্য হাজী ইসমাইল সাহেবের প্রপিতামহ থেকে বর্তমান পুরুষ পর্যন্ত এ বংশের ছয়/সাত পুরুষ এখানে বসবাস করছেন। আলোচিত তথ্য ও বসতির বিবর্তন থেকে গোবরচাকা গওহর চকের অপভ্রংশ বলে অনুমিত হয়। টুটপাড়া, বানরগাতী ও গোবরচাকা গ্রামের নাম কখন কিভাবে বিকৃত হয়েছে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে নামের সঠিক উচ্চারণে অজ্ঞতা, সহজীকরণ ও একশ্রেণীর লোকের অবজ্ঞা প্রসূত কারণে যে বর্তমান পরিণতি ঘটেছে তাতে সন্দেহের অবকাশের কথা নয়
জনসংখ্যা
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন জনসংখ্যা
মহকুমা সদর মির্জাপুর মাঠের এক কোণে নির্ধারিত হওয়ায় আলোচিত গ্রামগুলো সদরের দক্ষিণ, দক্ষিণ পশ্চিম ও পশ্চিমের দু’মাইলের মধ্যে অবস্থিত এবং গ্রামগুলি ঘনবসতিপূর্ণ ছিল না। আলোচ্য সময়ের (১৮৪০-৫০) জন- সংখ্যার কোন পরিসংখ্যান পওয়া যায় না। পরবর্তী সময়ে (১৮৫৩) জেলার বাড়ীর সংখ্যা গুনে প্রতি বাড়ীতে পাঁচজন লোক ধরে সার্ভে বিভাগ এক জরিপ করে। জরিপ রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামগুলোর জনসংখ্যা নির্ণয় সম্ভব নয়। পরবর্তী আধুনিক শুমারী পদ্ধতিতে ১৮৮১ সালে খুলনা শহরের জনসংখ্যা হয় ৭,৫৬৩ জন এবং মহকুমা সদরসহ পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমূহ এই গণনায় ধরা হয়েছিল। ১৮১১ সালে খুলনা শহরের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৮,৪১৬ জন। এই গণনায় কর্তৃপক্ষ শহর কতদূর গণ্য করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। তবে যে এলাকা নিয়ে পৌরসভা গঠিত হয়েছিল সে এলাকা যোগ ভিন্ন এ জনসংখ্যা স্বাভাবিক নয়। এ পরিসংখ্যান জেল, শহর প্রতিষ্ঠার ন’বছর পরের এবং এ সময়ের মধ্যে রেল লাইন ও ষ্টীমার সার্ভিস চালু হওয়ায় যাতায়াত ও তাদের শ্রমিক কর্মচারী এবং নবগঠিত জেলাসদরে নবাগতদের বসতির সমাগম ও পরিসংখ্যান। এ থেকে অনুমান করা যায় ১৮৯১ সালের পরিসংখ্যানের পঞ্চাশ বছর আগের জনসংখ্যা।
মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠার পর চল্লিশ বছর আয়ুষ্কালের মধ্যে সদরের কাছা- কাছি কিছু সরকারী কর্মচারী ও আইনজীবীর বাস ছাড়া গ্রামগুলোতে কোন নতুন বসতির সৃষ্টি হয়নি।
চলাচল
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন চলাচল
মহকুমা সদর ও জেলা সদরের মধ্যবর্তী সময় খুলনা সদর যে ক্ষুদ্র পরিসরে গঠিত হয়েছিল, সে এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা গ্রাম পরিবেশ ভিন্ন শহর পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। মহকুমা কাছারির দক্ষিণ পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চার্লীগঞ্জের হাটের সাথে সংযোগ ও কয়েকটা রাস্তার সামান্য সংস্কার ছাড়া কোন নতুন রাস্তা তৈরী হয়নি। মহকুমা সদর থেকে মহকুমার অভ্যন্তরে একমাত্র নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোন বিকল্প ছিলনা। তুর্ক-আফগান ও মুঘল যুগের যে-সব উন্নত রাস্তা ও যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল কোম্পানী শাসনের আগে থেকে ও কোম্পানী শাসনের দীর্ঘদিনের অবহেলা, সংস্কারের অভাবে জীর্ণ ও ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছিল ফলে নৌকাই একমাত্র চলাচলের অবলম্বন হয়। এ সময়ে মহকুমা প্রশাসক মহকুমার অভ্যস্তরে নৌকায় যাতায়াত করতেন। সাধারণ লোক যশোরে মামলা-মোকদ্দমা বা অন্যকোন কাজের প্রয়োজনে পায়ে হেঁটে বা নৌকায় যেতো। উল্লেখ্য খুলনা থেকে যশোর সাধারণ যাত্রীবাহী কোন নৌচলাচলের ব্যবস্থা ছিল না। প্রয়োজন মত পানসী বা ভাওয়ালে (পূর্ব বঙ্গের ভাওয়াল অঞ্চলের যাত্রীবাহী এক প্রকার সৌখিন নৌকা) ভাড়া করে যেতে হোত।
রূপসা খালের অপর পারের লোকেরা মহকুমা সদর ও বেনেখামার মিয়াবাগ-শিববাড়ী—বয়রা—মুজগুন্নী ও খালিশপুর যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা ছিল যশোর রোড। এ রাস্তার পূর্ব প্রান্তে জেলাস্কুল বোর্ডিং এর দক্ষিণ পুব কোনায় একটা প্রাচীন বটগাছের কাছে সরু রূপসা খালের উপর বাঁশের সাকো পার হয়ে এ পথে যাতায়াত করতো। পরে স্রোতাবেগ বৃদ্ধি পেয়ে খাল প্রশস্ত হলে এখানে খেয়া পারাপারের ব্যবস্থা হয়। এছাড়াও বর্তমান জেলখানা খেয়াঘাট বরাবর ও চার্লীগঞ্জের পশ্চিমে রেল এলাকা দিয়েও দুটো খেয়া পারাপারের ঘাট ছিল। ডেলটা ঘাট থেকে ষ্টীমার ঘাট রেল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার পর এ খেয়া ডেলটা ঘাটে নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া টুটপাড়া এলাকার লোকদের পারাপারের জন্য রূপসা শ্মশান ঘাটের উত্তর পাশের রাস্তার প্রান্তে রূপসা নদীর খেয়াঘাট ছিল।
মেথর ও ঝাড়ুদার
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন মেথর ও ঝাড়ুদার
মহকুমা প্রশাসনের কর্মচারী, প্রশাসকের বাসভবন ও কার্যালয়গুলো, ঝাড়ু দেয়া ও ময়লা পরিষ্কারের জন্যে সরকারী ভাবে বিহার অঞ্চলের কয়েকটি মেথর ও ঝাড়ুদার পরিবার এনে সদর থেকে দূরে তৎকালীন যশোর রোডের পাশে (ক্লে রোড থেকে জোড়া গেট পর্যন্ত) পাওয়ার হাউজের পাশ দিয়ে রেলষ্টেশনে যাওয়ার ডান পাশে, পানির ট্যাঙ্কের দক্ষিণে তাদের বসতি করান হয়। মেথর ও ঝাড়দারদের এখানে বসতি হয় বলে এ জায়গার নাম হয় ঝাড়ুখোলা অর্থাৎ ঝাড়ুদারদের জায়গা। রেল প্রতিষ্ঠার পর এ জায়গা রেল এলাকাভূক্ত হয়।
হাসপাতাল
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন হাসপাতাল
মহকুমা সদর প্রতিষ্ঠার ২২ বছর পর ভৈরব ষ্ট্র্যাণ্ড রোডে নদীর পাড়ে বর্তমান সদর হাসপাতালের জায়গায় ১৮৬৪ সালে একটা ছোট হাসপাতাল ও ডাক্তারখানা নির্মিত হয়। বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে বাংলার লেঃ গভর্ণর মি: উডবার্ণের নামে হাসপাতালটির নাম “উডবার্ণ হসপিটাল” রাখা হয়।
ষ্টীমার ও রেল
শহর খুলনার আদি পর্ব – আবুল কালাম সামসুদ্দিন ষ্টীমার ও রেল
১৮৭৯ সালে যশোর থেকে খুলনা পর্য্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণ ও স্টীমার সার্ভিস চালু করার তোড়জোড় শুরু হয় এবং ১৮৮০ সালে ক্লে রোডের উত্তর সীমায় ডেলটা ঘাট থেকে ষ্টীমার সার্ভিস চালু হয়। এর পরই জেলা ও জেলা সদর ঘোষিত হওয়ায় প্রকৃত পক্ষে শহর গঠনের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
১৮৮০ সালে যশোর থেকে খুলনা সদর পর্যন্ত রেল লাইন বসানো শুরু হয়। ষ্টেশন, রেল কর্মচারীদের বাসস্থান ও রেল লাইন বসানোর জন্যে চার্লীগঞ্জের হাটের নদীর পাড় দিয়ে একফালি জায়গা বাদে চাৰ্লী সাহেবের বাড়ীসহ সমস্ত চার্লীগঞ্জ হেলাতলার পশ্চিমাংশ মিয়াবাগ, শিববাড়ী গ্রানের বৃহদাংশ এবং শেখ পাড়া গ্রামের উত্তরের কিয়দংশ রেল এলাকার জন্য হুকুম দখল করে রেলওয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। রেলের পার্ণাপাশি ষ্টীমার সার্ভিস রাখার জন্যে নদীর পাড় দিয়ে নড়াইল কাছারী থেকে সাত নম্বর ঘাট পর্য্যন্ত নদীর পাড় ও ষ্টেশনের উত্তর-পূব কোণে এক খণ্ড জমি স্টীমার কোম্পানীর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। এই জমির উপর পাকা দেয়াল টিনের চালের স্টীমার ষ্টেশন নির্মিত হয়। ষ্টেশনের সামনে এক নম্বর ঘাট থেকে দুর পাল্লার যাত্রীবাহী ভারি ষ্টীমারগুলি যাতায়াত করতো।
বিস্তীর্ণ রেল এলাকার জন্যে নির্ধারিত হুকুম দখলী জমির উচ্ছেদকৃত বাসিন্দা চার্লীগঞ্জের কিছু ব্যবসায়ী পরিবার অবশিষ্ট হাট এলাকার মধ্যে উঠে আসেন এবং হেলাতলার (ক্লে রোডের পশ্চিম পাশের) বাকী বসতি ঐ অংশের পূর্ব-দিকে ও অন্যত্র সরে যায়। মিয়াবাগের সম্পূর্ণ এলাকা দখলীকৃত হওয়ায় বাসি দাগণ রেল এলাকার বাইরে আরও কিছুটা দক্ষিণ-পশ্চিমে সরে গিয়ে শিববাড়ীর পাশে পূর্ব নামে নতুন বসতি করেন এবং শেখপাড়ার উচ্ছেদকৃত পরিবারগুলি শেখপাড়ার মাঝে জায়গা করে নেয়। শিববাড়ী গ্রামের নদীর তীর ধরে বসতি পাল কুণ্ড ও কাকারের। এবং কয়েকটি বারুজীবী পরিবার বিভিন্ন জায়গায় বসতি করে। এ সবের মধ্যে পালদের কয়েকটা পরিবার নদীর অপর পারে দেয়।ড়া গ্রামে বসতি করে, বাকীরা বয়রা মধ্যে উঠে এসে নতুন পালপাড়া গঠন করে। কুণ্ড রাও অনুরূপভাবে কয়েকটি পরিবার রেনেখামার মধ্যে বাকী সকলে বয়রার দক্ষিণে বিলের পাশে বসতি করে কুণ্ডু পাড়া নামকরণ হয়। বারুজীবীরা সক লেই খালিশপুর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বসতি করেন। আলোচিত এলাকার অম্লান মুসলিম পরিবার সোনাডাঙ্গায় বসতি করেন। এ ছাড়া রেলওয়ের দখলীকৃত সীমার মধ্যে তাম্যদের কোন বসতি ছিল কিনা তা পরিষ্কার নয়, থাকলেও সম্ভবতঃ তারা আরও সরে যেয়ে গ্রামের মধ্যে বসতি করেছিলেন।
আলোচিত রেল এলাকার মধ্যে তৎকালীন যশোর রোড (ক্লে রোড থেকে জোড়াগেট পর্যন্ত) অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে জেলা সদর ঘোষিত হওয়ার পর রেল এলাকার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বিকল্প রাস্তা বা বর্তমান যশের রোড (ডাক বাংলা থেকে জোড়াগেট) নির্মিত হয়। পূর্বতন যশোর রোডের দক্ষিণ পাশে ও ফেরীঘাট রোডের উত্তর প্রান্তের সামান্য পশ্চিমে প্রথম রেলষ্টেশন নির্মিত হয়। এই ষ্টেশনে যাতায়াতের পুরাতন যশোর সড়কই প্রধান রাস্তা ছিল। ১৮৮৫ সালে এই ষ্টেশন পর্য্যন্ত রেলগাড়ী চালু হয়।
বইয়ের ধরন: অসম্পূর্ণ বই, ইতিহাস ও সংস্কৃতি
আবুল কালাম শামসুদ্দিনের “শহর খুলনার আদি পর্ব” বইটি খুলনা শহরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে রচিত। এতে খুলনার নামকরণ, বিভিন্ন এলাকার উৎপত্তি, জনবসতির বিবর্তন, এবং প্রশাসনিক পরিকাঠামো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। লেখক খুলনার প্রাচীন জনপদ, নদীবন্দর, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, এবং সামাজিক জীবনযাত্রার বিবরণ তুলে ধরেছেন। বইটিতে ঐতিহাসিক ঘটনা, কিংবদন্তি এবং স্থানীয় মানুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে খুলনার অতীতকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা পাঠককে শহরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত করে।
No comments:
Post a Comment