বিশ্বখ্যাত প্রতিভাবানরা ছোটবেলায় কেমন ছিলেন? কীভাবে তাঁরা তাঁদের জীবন শুরু করেছিলেন, যার জন্য পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছেন? এঁদের সম্পর্কে এমন অনেক কিছুই হয়তো তোমাদের জানতে ইচ্ছে করে। তাঁদের অনেকের ছেলেবেলার গল্প শুনলে তোমাদের কল্পনাও হার মানবে। তোমরা অনেকেই হয়তো ভাবো তাঁরা বাল্যকালেও মেধাবী ছিলেন এবং মেধাই তাঁদের বিখ্যাত করেছে। 'আমি মেধাবী ছাত্র নই, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না'- এ ধরনের ভাবনা ছাত্রজীবনে অনেকের মধ্যেই থাকে। এটি মারাত্মক ভুল একটি ধারণা। ছোটবেলায় দুর্বল ছাত্র ছিলেন এমন অনেকেই বড় হয়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। যারা নিজেদের দুর্বল ছাত্র ভাবো, তারা এ অধ্যায় পড়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে; বুঝতে পারবে চেষ্টা করলে তোমরাও একসময় মেধাবী হয়ে উঠবে
টমাস
এডিসন
একদিন ৪ বছরের একটি বাচ্চা স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরল তাঁর মাস্টার মশাইয়ের একটি ছোট চিঠি নিয়ে। মাস্টার মশাই তাঁর মাকে লিখেছেন, 'আপনার টমি এত বোকা যে তাঁর পক্ষে লেখাপড়া শেখা সম্ভব নয়। তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিন।' বালকটির মা প্রতিজ্ঞা করলেন, 'আমি তাঁকে নিজেই পড়াব, কারণ আমার টমি বোকা নয়।' সেই বোকা টমিই পরবর্তীকালের অসাধারণ প্রতিভাধর বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন; এই বোকা টমিই পরবর্তীকালে গ্রামোফোন যন্ত্র এবং বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার করেন। বড় হয়ে এডিসন নিজেই বলেছিলেন, 'এখন আমি পাতার পর পাতা মুখস্থ রাখতে পারি। আমার এই ক্ষমতাটা যদি ছোটবেলায় থাকত।'
আইনস্টাইন
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে ছোটবেলায় বলা হতো গবেট। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে তাঁর লেখাপড়া শুরু করতে করতেই নয় বছর পেরিয়ে যায়। স্কুলে ভর্তি হন অনেক দেরিতে। স্কুলের ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রথমবার ফেল করেন; দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেন। দু'দুবার পরীক্ষা দিয়ে তাঁকে এন্ট্রাস পাস করতে হয়। গাধা ছাত্র হওয়ার কারণে তিনি বাবার শখের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারেন নি। বড় হয়ে চাকরির চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হন। তাঁর স্মৃতিশক্তি এতই দুর্বল ছিল যে, ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারতেন না। স্মৃতিশক্তি নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন আইনস্টাইন। শুরু হয় স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা। মাত্র দু'বছরের চেষ্টায় স্মৃতিশক্তির অসাধারণ উন্নতি ঘটালেন। এর পরের ঘটনা সবারই জানা। তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় পরবর্তী ২০ বছরের মাথায় তিনি পদার্থবিজ্ঞানে লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন- 'আমার ছোটবেলা ও বর্তমানের মাঝে তুলনা করলেই আপনিই তা বুঝতে পারবেন।'
উড্রো
উইলসন
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে নয় বছর বয়স পর্যন্ত বর্ণমালাই শিখে শেষ করতে পারেন নি। পড়তে শেখায় লেগে গিয়েছিল আরও দুটি বছর। অথচ বড় হয়ে তিনি যে-কোনো বক্তৃতা একবার শুনে তা হুবহু মনে রাখতে পারতেন। ফলে পূর্ববর্তী বক্তার বক্তব্য খণ্ডন করতে তাঁকে কোনো অসুবিধায় পড়তে হতোনা।
গুস্তাভ
আইফেল
প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারটির ছবি কে না দেখেছ? এই আইফেল টাওয়ারের যিনি স্রষ্টা সেই গুস্তাভ আইফেলও প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন।
ইমাম গাজ্জালি
প্রখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালির ছোটবেলায় স্মরণশক্তি। একদম ছিল না। মনে না থাকার কারণে তিনি তার প্রয়োজনীয় কথা নোট করে রাখতেন। একদিনের এক ঘটনা- মরুভূমিতে গাজ্জালি ডাকাতের কবলে পড়েন। ডাকাত দল তার সর্বস্ব নিয়ে যায়। এমনকি তার নোট খাতাটিও। তিনি তখন ডাকাত দলের কাছ থেকে তার খাতাটি রক্ষার জন্য চেষ্টা করেন। গাজ্জালি ডাকাত দলের পেছনে পেছনে খাতার জন্য ছুটতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, 'আমার সকল জ্ঞান তোমরা নিয়ে যেও না।' ডাকাত দলের সর্দার উত্তর দেয়, 'যে জ্ঞান ডাকাতে নিয়ে যেতে পারে, সে জ্ঞান দিয়ে কি হবে?' ইমাম গাজ্জালি এরপর আর কোনো দিন কোনো কিছু খাতায় নোট করেন নি। পরবর্তীকালে তিনি কৌশলে অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী হয়ে ওঠেন। তাঁর রচিত বিশাল বিশাল গ্রন্থ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
হোমার
গ্রিসের অন্ধ কবি হোমারের কথা আমরা সবাই জানি। তাঁর স্মৃতিশক্তি বাল্যকালে ছিল অত্যন্ত দুর্বল। অন্ধ হওয়ার পর এক দোকানে বসে তিনি শ্রোতাদের ট্রয় যুদ্ধের কাহিনী আবৃত্তি করে শোনাতেন। পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিশক্তি এতই প্রখর হয়েছিল যে, যে-কোনো কাহিনী তিনি স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারতেন। তাঁর স্মৃতিতে ধরে রাখা কাহিনী থেকেই রচিত হয় 'ইলিয়ড' ও 'ওডিসি' মহাকাব্য।
অগাস্ত রদাঁ
বিখ্যাত ভাস্কর অগাস্ত রদাঁকে ছোটবেলায় বলা হতো গবেট। তাঁর স্মৃতিশক্তি এতই দুর্বল ছিল যে, স্কুলের শিক্ষকরা তাঁকে বলত ভুলো গবেট। অথচ পরবর্তীকালে নিজের চেষ্টায় তাঁর স্মৃতিশক্তির এতই উন্নতি হয়েছিল যে, অতীতের বহু ঘটনা তিনি হুবহু বলে দিতে পারতেন।
স্যামুয়েল
জনসন
ড. স্যামুয়েল জনসন, যিনি ইংরেজি ভাষায় প্রথম ডিকশনারি প্রণেতা, ছোটবেলায় তার স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত দুর্বল। পরবর্তীকালে তিনি স্মৃতিশক্তিকে বাড়াতে সক্ষম হন এবং ৭৮ বছর বয়স পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পেরেছিলেন।
জর্জ
প্যাটন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মার্কিন সেনানায়ক জর্জ প্যাটনের ছোটবেলায় স্মরণশক্তি ছিল খুবই দুর্বল। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণে তাঁকে একই ক্লাসে তিনবার থাকতে হয়েছে। অথচ পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিশক্তি হয়েছিল অসাধারণ।
উইলিয়াম
শেক্সপিয়র
ইংরেজি
সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের স্কুলজীবনে শিক্ষকরা ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুই উত্তর দিতে পারতেন না। শুধু মাথা নিচু করে থাকতেন। একবার এক শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন- এ ছেলের ভবিষ্যত অন্ধকার। যে ছেলে ক্লাসের পড়া পারে না, জীবনে সে কিছুই করতে পারবে না। অথচ - পরবর্তীকালে তিনিই হন অসাধারণ প্রতিভাধর।
অনেকের
সম্পর্কে জানলে, এবার ভিন্ন একটি ঘটনার কথা বলি তোমাদের। জীববিজ্ঞানের এক শিক্ষক ছাত্রদের শেখাচ্ছিলেন, শুঁয়োপোকা কীভাবে প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়। তিনি ছাত্রদের বললেন যে, পরবর্তী দু'ঘণ্টার মধ্যে শুঁয়োপোকার গুটি থেকে প্রজাপতি বেরিয়ে আসবে কিন্তু কেউ তাড়াহুড়া করে একে গুটি থেকে বের করার চেষ্টা করবে না। এই বলে তিনি ক্লাস থেকে চলে গেলেন। ছাত্ররা গুটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রজাপতি গুটি থেকে বের হওয়ার জন্য নড়েচড়ে চেষ্টা করছিল। একটি ছাত্র দয়াপরবশ হয়ে
শিক্ষকের
উপদেশ অমান্য করে গুটি ভেঙে একে বাইরে আসতে। সাহায্য করল। একে বাইরে আসার জন্য আর বেশি চেষ্টা করতে হলো না। কিন্তু অল্প সময় পরেই প্রজাপতিটি মারা গেল। শিক্ষক ফিরে এলে অন্য ছাত্ররা তাঁকে ঘটনাটি জানাল। তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝালেন যে, ওই ছাত্রটি সাহায্য করতে গিয়ে একে মেরে ফেলেছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই গুটি থেকে বেরোনোর সময় তাকে সংগ্রাম করতে হয়, ফলে প্রজাপতির দুটি ডানা বেড়ে ওঠে এবং শক্ত হয়। বালকটি একে সংগ্রাম করতে না দিয়ে তাকে বাঁচবার শক্তি সংগ্রহ করতে দেয় নি। এই তত্ত্বটি মানুষের জীবনেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। নিজস্ব চেষ্টা ছাড়া মানুষ জীবনে কিছুই লাভ করতে পারে না। মানুষকে তার আপন গতিতে চেষ্টা করা উচিত।
আইনস্টাইন,
এডিসন, মাইকেল এঞ্জেলো, হোমার, স্যামুয়েল জনসন, জেনারেল জর্জ প্যাটন, অগাস্ত রদাঁ, ইমাম গাজ্জালি, উইলিয়াম শেক্সপিয়র প্রমুখ মনীষীরা জন্মসূত্রে প্রখর স্মৃতিশক্তি পান নি। নিশ্চয়ই তাঁরা তা অর্জন করেছিলেন। তুমিও তোমার চেষ্টার মাধ্যমে স্মরণশক্তিকে উন্নত করতে পারো সহজেই। স্মৃতিশক্তিকে উন্নত করে তাদের মতো পৃথিবীতে বিখ্যাত না হতে পারলেও নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেই। জেনে রাখবে, সফল মানুষরা বেশি কিছু করেন না। তারা সামান্য কাজকেই তাদের নিষ্ঠা ও সততা দিয়ে বৃহৎ করে তোলেন।
প্রতিভাবানদের ছোটবেলার কথা জানার পর অবশ্যই তোমার ভুল ভেঙেছে। জেনেছ তোমার ছাত্রজীবনের স্মৃতিশক্তি তাদের চেয়ে খারাপ নয়। তারা স্মৃতিশক্তিকে উন্নত করতে পারলে তুমি কেন পারবে না? অবশ্যই পারবে। তাহলে, বুঝতেই পারছ, 'আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না'- এসব ভাবার সুযোগ তোমার নেই। এটি নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা মাত্র। এখন প্রশ্ন হলো, স্মৃতিশক্তিকে কীভাবে উন্নত করা যায়? বিভিন্ন উপায়ে তা করা যায়। এই স্মৃতিশক্তিকে উন্নত করার কয়েকটি পদ্ধতি তোমাদের জন্য যুক্ত করা হয়েছে। সেটা পরে জানতে পারবে।
No comments:
Post a Comment