রাগের সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত, রাগ নিয়ে সবার জীবনেই দু-একটি স্মৃতি খুব নাড়া দেয়। আসলে রাগ একটি অতি মনো-শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, কিন্তু এটি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন তা পারস্পরিক সম্পর্কের, ব্যক্তিগত কাজের ও জীবনযাত্রার নানামুখী বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। রাগের সম্ভাব্য দুর্দশার পূর্বাভাস ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিমাপের কার্যকর কোন স্কেল এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। সুতরাং রাগকে নিজ থেকে মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারা স্বাভাবিক, সুন্দর, সাবলীল জীবনযাপনের জন্য অতীব জরুরি। রাগ কী (What is Anger) Anger is “an emotional state that varies in intensity from mild irritation to intense fury and rage” according to Charles Spielberer. PhD, a Psychologist and specialist in the study of Anger. তা ছাড়া রাগ হলো একটা আবেগমূলক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। যখন কেউ রেগে যায় তখন Heart bit বেড়ে যায়, Blood Pressure বেড়ে যায়, মুখ বা কান রক্ত বর্ণ ধারণ করে, Hormone Serration বেড়ে যায় যা শরীরের দীর্ঘমেয়াদি খারাপ প্রভাব সৃষ্টি করে।
রাগ প্রদর্শনের ধরন (Expressing quality of Anger): গঠনমূলকভাবে রাগের প্রকৃতি Aggressive. এ ছাড়াও রাগ ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী ও অন্যের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করে। ন্যূনতম রাগ আমাদের পরিবেশের সাথে মানানসই হওয়ার জন্য প্রয়োজন। অন্য দিকে শারীরিক উত্তেজনা, মানসিক অস্থিরতা আমাদের প্রচলিত আইন, সামাজিক মানদন্ড ও ভদ্রতার সীমারেখাকে প্রভাবিত করে। মানুষ রাগান্বিত অবস্থায় ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত অনেক কিছু করতে পারে। রাগ প্রদর্শনের তিনটি মৌলিক ধরন হচ্ছে-
(১) নিজেকে উপস্থাপন করা/অভিব্যক্তির প্রকাশ করা
(২) দমন করা
(৩) শান্ত করা।
রাগের প্রক্রিয়াটি যদি Aggressive হয়, Not aggressive এই প্রক্রিয়াটি রাগ প্রকাশের স্বাস্থ্যসম্মত পথ। সেটাই করা উচিত এবং সেটাই শেখা উচিত অন্যকে কষ্ট না দিয়ে প্রয়োজন উদ্ধার কিভাবে করা যায় এটির সর্বোত্তম চেষ্টা থাকা বাঞ্ছনীয়। রাগকে দমন করলে তা অন্য রূপে প্রকাশ পেতে পারে।
সুতরাং যখন রাগ আসে তখন সেই রাগ সংক্রান্ত চিন্তাকে Stop করা এবং নতুন Positive চিন্তার পরিবর্তন করা দরকার। এই লক্ষ্যে রাগ দমন করা এবং গঠনমূলক কাক্সিক্ষত আচরণ করার পথকে সুগম করা। কিন্তু যদি অন্যথা হয় তবে রাগ নিজের দিকে ফিরে আসবে এবং Hypertension, high blood pressure or depression এর জন্ম দেবে। অত্যধিক রাগ আরো জটিল সমস্যা তৈরি করতে পারে যা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার, ব্যক্তিত্বের ও আচরণের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। আর এ ধরনের পরিবর্তন স্থায়ীভাবে সুন্দর সম্পর্ককে দুর্বিষহ ও পারিবারিক এবং সাংগঠনিক সম্পর্ককে অসহনীয় করে তুলবে। Quick tips for cooling down (দ্রুত/আপদকালীন রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল) ঋFocus on the Physical sensation of anger (রাগের কারণে শারীরিক পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করা)- রাগ যেহেতু Emotion-এর বহিঃপ্রকাশ সুতরাং রাগের সাথে শরীরে বিশেষ কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। সেই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে প্রস্তুতি নেয়া যেতে পারে। রাগ হলে কান গরম বা লাল হয়ে যেতে পারে, অজান্তেই হাত মুষ্টিবদ্ধ বা অতিরিক্ত Emotion এর কারণে ঘাড় এর শিরা-উপশিরাগুলো টান টান হয়ে যেতে পারে। এ লক্ষণের শুরুতেই নিয়ন্ত্রণের কৌশল প্রয়োগ শুরু করতে হবে। Take some deep breaths (গভীরভাবে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে হবে)- গভীর নিঃশ্বাস Tension কমাতে সাহায্য করে। কারণ এর ফলে Heat এ অক্সিজেনসমৃদ্ধ বাতাস পায় যা হরমোনের নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করে। Use your senses (অনুভূতিকে ব্যবহার করা)- রাগের সময় তোমার অনুভূতিগুলোর সঠিক ব্যবহার রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যেমন- Sight (দৃষ্টি), Smell (গন্ধ), Hearing (মৃদু শ্রবণ), Touch (স্পর্শ) and Taste (স্বাদ)। Sight (দৃষ্টি)- সবুজ ঘাস, সবুজ মাঠ, সবুজ গাছ কিংবা বাগানের রঙিন ফুল ঝর্নার অপরূপ সৌন্দর্য, নদীর কুলকুল বয়ে যাওয়া কার না মন শীতল করে, কার না চোখ জুড়ায়। মনের এসব গভীর অনুভূতিকে কার্যকর ব্যবহার করার অভ্যাস রাগকে নিয়ন্ত্রণে বিশেষ সহায়ক। Smell (গন্ধ)- প্রিয় পারফিউম, প্রিয় আতর কিংবা প্রিয় ফুলের গন্ধ মনকে নতুন অনুভূতির সন্ধান দেবে, তাই যাদের রাগের বাতিক আছে তারা এগুলো সঙ্গে রাখুন এবং প্রয়োজনে সুবিধা নিন।
Hearing(মন জুড়ানো সুর)- সুরের মূর্ছনা মানুষের মনকে বিমোহিত করে, প্রিয় সুর ভুলিয়ে দিতে পারে সব রাগ, সব ক্ষোভ, সব দুঃখ, সকল যন্ত্রণা, প্রশান্ত করে অন্তরাত্মা। পরিচিত গানের সুর যেমন- “দূর আজানের মধুর ধ্বনি-বাজে বাজে মসজিদের মিনারে-একি খুশির মধুর তরঙ্গ ... ” Touch(স্পর্শ)- প্রত্যেকের জীবনেই কিছু ছুঁয়ে যাওয়া স্পর্শ থাকে, যা নিয়ে যেতে পারে কল্পনার সুন্দর ভুবনে। যেমন- মায়ের ¯েœহের পরশ, বাবার উষ্ণ আদরের বন্ধন ক্রোধের আগুনকে মুহূর্তে শীতল করে দিতে পারে। ক্রোধের আগুনকে নেভাতে এই অনুভূতিগুলোর ব্যবহার রপ্ত করুন।
Taste (স্বাদ) - স্বাদ মানুষকে আত্মভোলা করে যেমন- বিজ্ঞাপনে ‘ফ্রুটিকা’ নিজের গোপন দুর্বলতাগুলো বের করে নিয়ে আসে ঠিক তেমনি প্রিয় স্বাদ আপনার রাগকে ঠান্ডা করতে পারে। আসলে প্রিয় কিছুর মাধ্যমে রাগের দিক থেকে মনকে ফেরানোর কৌশলটাই আয়ত্ত করা দরকার যা রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য অনন্য ভূমিকা রাখবে।
Stretch or Massage areas of tension- টেনশনের সময় ম্যাসেজ করুন- যখন রাগ হয় তখন- ঘাড়ে আস্তে আস্তে ম্যাসেজ করলে কোষগুলো শিথিল হয় ও রাগ নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করে।
Slowly Count to ten- (ধীরে ধীরে দশ পর্যন্ত গুনুন)- রাগ হতে শুরু করলে শান্তমনে রাগ কমানোর আগ্রহ নিয়ে (১-১০) এবং (১০-১) পর্যন্ত ধীরে ধীরে গুনতে শুরু করুন। একবারে রাগ না কমলে Smoothly বারবার চালিয়ে যান। দেখবেন রাগ কমে গেছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞানী হজরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন- “রাগ হলে ওজু কর, দাঁড়ানো অবস্থায় রাগ হলে বসে পড়ো, বসা অবস্থায় রাগ হলে শুয়ে পড়ো।” এটা রাগ নিয়ন্ত্রণের একটি অত্যাধুনিক কৌশল-কারণ বৈজ্ঞানিকভাবে এটি প্রমাণিত, যে কোন উত্তেজনার সময় পানির স্পর্শ উত্তেজনাকে প্রশমিত করে। রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল রাগ নিয়ন্ত্রণকে Challenge হিসেবে নেয়া। ‘আমি’ কে নিয়ন্ত্রণ করাই রাগ নিয়ন্ত্রণের সহজ শর্ত।
রাগ নিয়ন্ত্রণের দশ কৌশল:
এক. কথা বলার আগে চিন্তা করা: অন্যের ওপর রাগ হলে সহজেই অনেক কিছু বলা হয়ে যায়, যা সম্পর্কের সুন্দর পরিবেশটাকে নষ্ট করে। সুতরাং কথাগুলো বলার আগে একটু চিন্তা করে নিতে হবে ও অন্যকে সম্পৃক্ত মূল্যায়ন করতে হবে। অর্থাৎ অন্যের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে আত্মবিচার করতে হবে। দৃষ্টি নিচের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন- যার জুতার জন্য দুঃখ, সে পা না থাকা মানুষের দুঃখকে মূল্যায়ন করবে, চিন্তা করবে, পরিবেশ সহজ হয়ে যাবে, রাগ কমে যাবে।
দুই. রাগের কারণ ব্যাখ্যা করা : রাগের সময় যত দ্রুত সম্ভব রাগের কারণ অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করা এবং হ্যাঁ সূচক/সহজ করে ভাবতে চেষ্টা করা। ঐ সংশ্লিষ্ট বিষয়টা নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান করা এবং প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে ঠান্ডা মাথায় রাগের কারণ বিশ্লেষণ করলে, প্রকৃত বিষয় সামনে চলে আসবে তখন দেখা যাবে রাগ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
তিন. নিয়মিত কিছু ব্যায়াম করা : মানসিক চাপ থেকেই রাগের সৃষ্টি হয়, ব্যায়াম Stressকে দূর করে। যখন রাগ বাড়তে থাকে তখন ঘর থেকে বের হও, হাঁটাহাঁটি করা, দৌড়ান অথবা আনন্দদায়ক কোন শারীরিক কাজে নিজেকে যুক্ত করা। তাতে রাগ দূরে সরে যাবে।
চার. সময়ানুবর্তী হওয়া: সময় শিশুর মতো, নিজের মতো করে ব্যবহার করতে শেখা। দিনের একঘেয়ে কাজের মাঝে একটু হলেও অবসরে যান। কাজের মধ্যে বৈচিত্র্য আনুন, জীবন আনন্দময় হবে, রাগ ও অস্বস্তি দূর হবে।
পাঁচ. সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করুন : যে যে বিষয়ের জন্য রাগ হয় সেই বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করা। যেমন- সন্তান অথবা অন্য কেউ বারবার বিরক্ত করলে রাগ হয়..! কাজের সময় দরজা বন্ধ করে কাজ করুন, যন্ত্র ব্যবহারের সময় বারবার নির্দেশনা দিলেও উত্তর না মিললে রাগ হয়, তাই যন্ত্র মেরামত করে কাজ শুরু করুন, কোন কিছু খুঁজে না পেলে রাগ হয় তাই প্রয়োজনীয় জিনিস নির্দিষ্ট জায়গায় রাখুন। রাগের পরিবেশ কমে যাবে, রাগ করতে হবে না।
ছয়. নিজের ওপর সিদ্ধান্ত দিন: অন্যকে উপহাস করা বা অপবাদ দেয়া বন্ধ করুন। এগুলো Tension এর জন্ম দেয়। Tension Stress Anger রূপান্তরিত হয়।
সাত. একগুঁয়েমি ত্যাগ করুন : ক্ষমা একটি বড় সম্পদ। অধিকাংশ রাগের কারণ নিজেকে বড় করে দেখা বা অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ভাবা, যা Ego Problem নামে পরিচিত। নিজের এই সব অপ্রয়োজনীয় শ্রেষ্ঠত্বের জায়গাগুলোকে ছাড় দিলে ও নিজেকে সাধারণের সারিতে ভাবতে শিখলে সহজেই রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
আট. রাগ দূর করতে মানবতাবোধকে কাজে লাগান: নিজেকে বড় করে ভাবা ও নিজের জন্য বেশি আকাক্সক্ষা করা অনেক সময় রাগের জন্মদাতা। আবার রাগের কারণ অনুসন্ধানে পাওয়া যায় অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব আকাক্সক্ষা থেকেই বেশির ভাগ সময় রাগের সৃষ্টি হয়। তাই মানবতাকে লালন করুন রাগের সমাধান মিলবে।
নয়. জবষধীধঃরড়হ এর দক্ষতা অর্জন করা: নিজেকে শিথিল করার কৌশল আত্মস্থ করা। যেমন- Deep breathing, Imagine a relating scene etc. এ ছাড়াও গান শুনুন, পত্রিকা পড়–ন, কবিতার বই পড়–ন কিছু লেখা বা আঁকার অভ্যাস করুন এবং সকল পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করুন।
দশ. সহযোগিতার মানসিকতা তৈরি করা : সহযোগিতার জন্য মানসিকতা তৈরি করাটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। অপরকে ছাড় দেয়ার, ক্ষমা করার, সহানুভূতি দেখানোটাকে প্রাত্যহিক জীবনের জন্য সহজ করে নেয়া ও সহনীয় পরিবেশ তৈরি করা, যা অপ্রয়োজনীয় শ্রেষ্ঠত্ব থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়ে রাগের বিনাশ সাধন করবে। কোয়ান্টাম মেথডের একটা উক্তি বেশ জনপ্রিয় ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’। এটা অনুধাবন করতে ও মেনে চলতে চেষ্টা করুন। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে রাগী মানুষ হিসেবে পরিচিত হজরত ওমর (রা) রাসূল (সা)-এর কাছে জানতে চাইলেন এমন কোন কাজ আছে কিনা যা আল্লাহর গজব থেকে রক্ষা করবে? রাসূল (সা) বললেন, ‘তুমি রাগ দেখাবে না।’ (বুখারী) উপরোক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায় রাগ গজব ডেকে আনে। অনেকে রাগকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মনে করে। কিন্তু রাসূল (সা) এই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “সেই ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে কুস্তি লড়তে পারে বরং প্রকৃত শক্তিশালী হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে।” (্বুখারী ও মুসলিম ) রাসূল (সা) বলেছেন, “ক্রোধ হলো আগুন যা মানুষের সৎ কর্মগুলো জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়।” তাই এই ক্ষতি থেকে সকলকে দূরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করা দরকার। আল্লাহ আমাদের সকলকে রাগের সব ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত করুন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে তার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।
No comments:
Post a Comment