মো. জাহিদ হোসেন শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন ছয় মাস আগে। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী বলেন, কোনো এক টিভি চ্যানেলে বিশিষ্ট একজনের সাক্ষাৎকারে বলতে শুনেছিলাম, এক-তৃতীয়াংশ তরুণ আজ হতাশাগ্রস্ত। এই পরিসংখ্যানটা আমার কাছে সত্যিই মনে হয়। বর্তমান সময়ে একজন তরুণ-তরুণী সর্বোচ্চ শিক্ষা শেষ করেও চাকরি পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এর জন্য দায়ী আমাদের ব্যবস্থাপনা। বর্তমানে মেধা, যোগ্যতা, সম্ভাবনা সব কিছু চলে যাচ্ছে গুটিকয়েক এলিট শ্রেণির হাতে। যে কারণে আমরা তরুণ সমাজ স্বপ্নভঙ্গ আর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পেরে হতাশায় ভুগছি। বেশ কয়েক মাস থেকে আমি চাকরি খুঁজছি। অনলাইনে বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করার পর দুই তিনটা ডাক পেয়েছি। তবে মজার বিষয় হলো এন্ট্রি লেভেলের একটি চাকরির জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এত অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয় এটা আবেদন না করলে কেউ টের পাবে না। এত কিছুর পর যখন বেতনের কথা আসে তখন বলে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার বেশি তারা দিতে পারবে না। এত টাকা দিয়ে পড়ালেখা শেষ করে যদি এই বেতনের চাকরি করতে হয় তাহলে আমি পড়ালেখা কেন করেছি। আর বর্তমান সময়ে জীবনযাত্রার মান এমন যে এই টাকা দিয়ে খেয়ে পরে একটা মানুষ এই শহরে থাকতে পারবে না। তবে বলেন হতাশ না হয়ে আমাদের কি করার আছে। আর সরকারি চাকরি পেতে হলে যে কি কি করতে হয় সেটা একমাত্র তারাই ভালো বলতে পারবে যারা সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভায় আটকা পড়েছে। শুনেছি, পঞ্চাশ থেকে আশির দশকের সময়কালে কোন চায়ের স্টল কিংবা হোটেল অথবা কোন পাড়ার মোড়ে যখন কয়েকজন তরুণ একত্রে দাঁড়িয়ে কথা বলত তখন তাদের সেই কথা অধীর আগ্রহ নিয়ে শোনার জন্য পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়ে যেতেন। এমনকি সেই গুটিকয়েক তরুণের চলমান কথা পরিবারের অন্যদের সাথে নির্দ্বিধায় আলোচনা পর্যন্ত করা হতো। অথচ, বর্তমান সময়ে এক সাথে গুটিকয়েক তরুণ-তরুণী কোথাও জটলা করে দাঁড়ালেই অনেকের কাছেই আজ আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন এই আতঙ্ক? সেই আতঙ্কের জন্য কি আমরা তরুণ সমাজ দায়ী? মোটেও না। বেশ কবছর ধরে রাজনৈতিক যে অরাজকতা চলছে তাতে করে রাজনৈতিক স্বার্থে কিছু তরুণ ব্যবহারের ফলেই আজ সর্বসাধারণের মনে সেই ভয়ভীতি প্রবেশ করেছে।
ঢাকা পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করে বিসিএস-সহ অন্যান্য সরকারি চাকরির জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন মশিউর রহমান। সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা চলছিল অনার্স লেভেল থেকেই। তবে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা হয়নি। মশিউর বলেন, আসলে এইসব চাকরি পেতে হলে মেধার পাশাপাশি উপরের লেভেলে লোক থাকা লাগে। সেই সাথে কোটা থাকলে চাকরিটা এতদিনে হয়ে যেত। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি ভাগ্যে থাকলে হয়তো হয়েও যেতে পারে। তবে খারাপ লাগে যখন দেখি একসঙ্গে পড়াশোনা করার পরও পরিচিত মানুষ থাকায় আমার থেকে খারাপ রেজাল্ট করেও অনেকের চাকরি হয়ে গেছে। মশিউর বলেন, সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় যখন বাবা মলিন কণ্ঠে প্রতিদিন জানতে চান চাকরির কোনো ব্যবস্থা হয়েছে কিনা। তবে সবসময় চেষ্টা করি নিজেকে হতাশা থেকে দূরে রাখতে। ভালো চিন্তা করি যেন নিজের অজান্তে কখনো ভুল পথে চলে না যাই। তবে এখন অবশ্য চেষ্টা করছি স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে। আইএলটিএস পরীক্ষা দেবো পরের মাসে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি সব মিলিয়ে যাতে সাত পয়েন্ট পাই। তাহলে হয়তো আর কোনো বাধা থাকবে না স্কালারশিপ পেতে। শুধু জাহিদ কিংবা মশিউর নয়, এই রকম হতাশায় ভুগছেন অনেক তরণ-তরুণী। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী। আর এসব তরুণের অনেকেই নিজেদের অবস্থান নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এসব তরুণের কেউ কেউ আবার দেশে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশানুরূপ অবস্থা না দেখে বিদেশে পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
হাসিব রহমান ঢাকা কলেজ থেকে একাউন্টিং নিয়ে মাস্টার্স শেষ করেছেন প্রায় এক বছর হলো। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করার পর থেকে সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন। গত বছর সোনালী ব্যাংকের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভাইভায় হয়নি। হাসিব বর্তমানে একটি কল সেন্টারে চাকরি করছেন। তবে সরকারি চাকরির আশা এখনো ছাড়েননি তিনি। হাসিব বলেন, জানি সরকারি চাকরি পেতে হলে পড়ালেখার বাইরে লিঙ্ক, টাকা থাকতে হয়। আমাদের যদি এত টাকা থাকতো তাহলে চাকরির জন্য না ঘুরে কোনো ব্যবসা শুরু করতাম। অবশ্য মাস্টার্সে যে সার্কেলটা ছিল এর মধ্যে কেউ কেউ বেসরকারি ব্যংকগুলোতে চাকরি নিয়ে ভাল অবস্থানে আছেন। এছাড়া বাকিরা কেউ চাকরি খুঁজছেন এখনো আর কেউ হয়তো আমার মতো অল্প বেতনে কোথাও লেগে আছেন কোনোরকম জীবন বাঁচানোর জন্য।
শুধু যে তরুণরা নিজেদের হতাশার কথা বলছেন সেটা কিন্তু নয়। কিশোর-কিশোরীরাও এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে হতাশায় ভুগছেন। আরমানিটোলা স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র হাফিজ আল আসাদ। হতাশার কথা বলতেই আসাদ বলেন, আপু আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি চিন্তা আর হতাশায় থাকি আমি। এত চাপ নিয়ে থাকা যায়। আম্মু সবসময় একই কথা বলে বকা দেন। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে। অন্যরা যদি এত ভালো মার্কস পায় তাহলে আমি কেন পাই না। অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করলে ভালো লাগে না। আমি একদমই সহ্য করতে পারি না। আর আমার বন্ধুরা সবাই নতুন নতুন গেমস খেলে। ওরা মাঠেও খেলতে যায়। আমাকে কোথাও যেতে দেয় না। গান, আবৃতি, ছবি আঁকা সবই করি। এর থেকে ভালো মানুষ কিভাবে করে। আসাদের সবচেয়ে বেশি ভালো সময় কাটে যখন ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে যায় পরিবারের সঙ্গে।
তরুণরা যে শুধু চাকরি না পেয়ে অথবা স্বপ্ন ভেঙে হতাশ হয় সেটাও নয়। ভালো অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের ছেলে মেয়েরা হতাশায় ভুগে অন্য কারণে। তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে বেশি সময় পায় না। জবাবদিহি করতে হয় না। হয়তো এসব পরিবারের বাবা-মা মনে করেন ছেলে মেয়েকে স্বাধীনভাবে থাকতে দিলেই তারা ভালো থাকবেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। প্রত্যয় রায় প্রিয় একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পরই চাকরির আবেদন শুরু করেন। তবে বিশ্ববদ্যালয়ে থাকা অবস্থায়ও অনলাইনভিত্তিক প্রজেক্টে কাজ করেছেন। সেই সুবাদেই চাকরি পেতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। তবে প্রিয় বলেন, চাকরিটা না করলেও যে কোনো সমস্যা হতো আমার সেটা কিন্তু নয়। আমি কাজ করছি সময় কাটানোর জন্য। অফিসে অনেকেই আছেন আশপাশে। কিন্তু বাসায় থাকলে সবসময় একা থাকা লাগে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা তো সবসময় দেয়া যায় না। সব কিছু ঠিক আছে তবুও হতাশায় ভুগছেন প্রিয়। হতাশার কারণ হিসেবে প্রিয় বললেন, এমনিতে পরিবারে মানুষ কম। তার মধ্যে সবাই খুব ব্যস্ত থাকে। আমিও ছোটবেলা থেকে কম্পিউটারের দিকে ঝুঁকে পড়ি। যদিও কখনো ওইভাবে এসব বিষয় নিয়ে ভাবা হয়নি তবে এখন মনে হচ্ছে আমি আসলেই হতাশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ সমাজের অধিকাংশই সঠিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই হতাশায় ভুগছেন। এছাড়াও বর্তমানে সময়ে সবকিছুতেই প্রবেশাধিকার অনেক বেশি। তরুণরা অন্যদের জীবন যাপন দেখে নিজের জন্যও অনেক সময় সে রকম জীবনের চিন্তা করে। আর সেটা হয়তো অর্থনৈতিক কারণে কিংবা নিজের ব্যক্তিগত কারণে যখন পায় না তখনই তারা হতাশায় ভোগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, তরুণরা বেকারত্বের চিন্তা, পারিবারিক চাপ, রাজনৈতিক আদর্শহীনতা বিভিন্ন কারণে হতাশ থাকে। এছাড়াও তারা যখন দেখে ভালো রেজাল্ট করার পরও আসলে চাকরির কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। রাষ্ট্রে সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোনো কিছু হচ্ছে না তখনই তারা হতাশায় ভোগে। এদেশে ঘুষ, দুর্নীতি কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া চাকরি পাওয়া কঠিন। অযোগ্য মানুষরা দলীয় আনুগত্যের কারণে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই দৌড়ে তরুণ মেধাবীরা মার খেয়ে যাচ্ছে। রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, তরুণরা যখন দেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে জীবনযাত্রার মান অনেক ভালো, সুন্দর পরিবেশ তখন নিজেদের অবস্থার কথা ভেবে তারা হতাশ হয়। এছাড়াও বর্তমান তরুণদের সামনে কোনো রোল মডেল নেই যাকে সে অনুকরণ করবে। হয়তো সেকারণেই খুব সহজেই তারা অন্য দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তবে এখন যেটা করা যেতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংস্কৃতিক চর্চা করতে হবে। পরিবার থেকে সচেতন হতে হবে।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. হামিদুল হক বলেন, একটা কথা না বললেই নয়, বর্তমান সময়ে তরুণ সমাজের যতটুকু পাওয়ার কথা সেটা সঠিকভাবে পায় না। সেটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার কিংবা রাষ্ট্রের কাছ থেকে হোক। তবে এটাও সত্যি এখন ছেলেমেয়েরা অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়ে। কারণ আমরা বড় হয়েছি হাটে মাঠে মুক্ত আলোতে। সত্তরের দশকে আমরা হতাশা কি সেটাই জানতাম না। এখন সবকিছুই খুবই ঘরোয়া হয়ে ঘেছে। সেটা খেলাধুলা হোক আর পড়ালেখা হোক। তিনি বলেন, যদিও এই কথাটা প্রায়ই শোনা যায় চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয় তরুণরা। তবে আমার ধারণা এখন নির্দিষ্ট চাকরির বাইরে ছেলেমেয়েদের কাজের সুযোগ অনেক বেড়েছে। তবে চিন্তার সুযোগ করে দিতে হবে এই প্রজন্মকে। যেন তারা মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে। কোনোভাবেই যেন সঠিক সুস্থ চিন্তা থেকে হারিয়ে না যায়।
তরুণদের হাতেই সভ্যতার সূচনা। তরুণদের কাঁধে ভর করেই এগিয়ে চলছে পৃথিবী। যত ক্লান্তি, দুঃখ, গ্লানি রয়েছে তা দূরীকরণে অগ্রপথিক বরাবরই তরুণেরা। যদিও আগের সেই গতি তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না তরুণদের মাঝে। তারা আজ যেন ছন্দহীন হয়ে পড়েছে। আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য তাদের মাঝে অনুপস্থিত।
No comments:
Post a Comment